মুম্বাইয়ের শিবাজি পার্কে বাজছে ‘নাইটিংগেল অব ইন্ডিয়া’ লতা মঙ্গেশকরের দেশাত্মবোধক গান। অগণিত ভক্ত, অনুরাগীর ভিড়ে শিবাজি পার্ক এখন জনসমুদ্র। রোববার সন্ধ্যা ঠিক সাড়ে ৬টায় এই পার্কেই শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে ‘ভারতরত্ন’ লতার। নশ্বর দেহ ছেড়ে অনন্তলোকে যাত্রা করবেন সঙ্গীতের মহামহিম এই শিল্পী।
লতা মঙ্গেশকরের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে আসতেই শিবাজি পার্কে ভিড় করছেন ভক্ত, অনুরাগীরা। শেষকৃত্য অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার জন্য মুম্বাই পুলিশ কঠোর নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে রেখেছে শিবাজি পার্ক। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
ভারত ইতোমধ্যে দুদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। রোববার ও সোমবার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। এ সময়ে রাষ্ট্রীয় যেকোনো বিনোদন অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
নিজ বাড়ি ‘প্রভুকুঞ্জ’ থেকে স্থানীয় সময় পৌনে ৬টার দিকে লতা মঙ্গেশকরের মৃতদেহ শিবাজি পার্কে নিয়ে যাওয়া হয়। তার কফিন ঢেকে দেওয়া হয়েছে ভারতের জাতীয় পতাকায়।‘প্রভুকুঞ্জ’ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হাতজোড় করে প্রণাম জানান ভারতের সঙ্গীতের আরেক জীবন্ত কিংবদন্তি, তার ছোট বোন আশা ভোঁসলে।
লুধিয়ানার সভা থেকে প্রয়াত শিল্পীর ছবিতে মাল্যদান ও ফুল দিয়ে লতাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর।
টানা প্রায় চার সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর রোববার সকাল সোয়া আটটার দিকে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন লতা মঙ্গেশকর। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় গতকাল শনিবার সকালে এ সংগীতশিল্পীকে ভেন্টিলেটর সাপোর্টে নেওয়া হয়। তখন চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, কিছুটা সাড়া দিচ্ছেন লতা। তার বিভিন্ন থেরাপি চলছে। কিন্তু সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি এ কোকিলকণ্ঠীর।
জানুয়ারি মাসের শুরুতে করোনায় আক্রান্ত হন লতা মঙ্গেশকর। তখন থেকেই ভর্তি ছিলেন মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালের আইসিইউতে।
৮ জানুয়ারি থেকে সেখানেই ছিলেন তিনি। শুরু থেকে চিকিৎসক প্রতীত সমধানীর চিকিৎসাধীন তিনি। প্রথমে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একসময় কোভিড নেগেটিভ হলেও পরে নিউমোনিয়া ধরা পড়ে। চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছিলেন। সম্প্রতি প্রবাদপ্রতিম গায়িকার শারীরিক পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ভেন্টিলেশন সাপোর্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আশার আলো দেখছিলেন চিকিৎসকেরাও। তবে শনিবার লতা মঙ্গেশকরের শারীরিক পরিস্থিতির আবার অবনতি হয়।
শনিবার দুপুরে চিকিৎসকেরা জানান, গায়িকার অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক। সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই অনুরাগীরা তার আরোগ্য কামনা করেন।
এদিকে শনিবার সন্ধ্যাবেলা দিদি লতাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান আশা ভোসলে। তখন থেকে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। ভক্ত, পরিবারের সবাই তার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করতে থাকেন। চিকিৎসকেরাও চেষ্টা করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টা ব্যর্থ করে চলে যান কিংবদন্তিতুল্য এ শিল্পী।
১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এক মারাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন লতা মঙ্গেশকর। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই বাবাকে হারান। তার আগে অবশ্য বাবার হাত ধরেই অভিনয় এবং গান শিখতে শুরু করে দিয়েছিলেন। ১৩-১৪ বছর বয়সেই প্রথম বার সিনেমায় গান গাওয়া, মারাঠি ছবিতে। প্রথম হিন্দি ছবিতে গান করেন ১৯৪৮ সালে, ছবিটির নাম ছিল ‘মজবুর’।
১৯৪৯ লতার গাওয়া ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি হিট হওয়ার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অনবদ্য গায়কী দিয়ে ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন ভারতীয় উপমহাদেশের সুর সম্রাজ্ঞী।
ভারতীয় উপমহাদেশের সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর তার কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি ২০০১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ভারতরত্নে ভূষিত হন। এর আগে লতা ১৯৯৯ সাল ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণে ভূষিত হন। তিনি ১৯৬৯ সালে তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে ভূষিত হন।
এই সঙ্গীতশিল্পীকে ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাদের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা লেজিওঁ দনরের অফিসার খেতাব প্রদান করে। এ ছাড়া তিনি ১৯৮৯ সাল দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারে ভূষিত হন।
লতা মঙ্গেশকরের ঝুলিতে রয়েছে মহারাষ্ট্র ভূষণ পুরস্কার (১৯৯৭), এনটিআর জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৯), জি সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার (১৯৯৯), এএনআর জাতীয় পুরস্কার (২০০৯), শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে তিনটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ১৫টি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার।
এ ছাড়াও লতা শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে চারটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি ১৯৬৯ সালে নতুন প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীকালে তিনি ১৯৯৩ সালে ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার এবং ১৯৯৪ ও ২০০৪ সালে দুইবার ফিল্মফেয়ার বিশেষ পুরস্কার অর্জন করেন।