সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিএনপির মেয়রদের

রাজনীতি

2ba294583531e8fa5624f2aad383ec5e-18.1

আরিফুল হক,মোসাদ্দেক হোসেন,এম এ মান্নানএকের পর এক মামলায় জড়িয়ে মেয়র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিএনপির নির্বাচিত মেয়রদের। ইতিমধ্যে সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আজ রোববার গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র এম এ মান্নানের স্থলে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্যানেল মেয়র আসাদুর রহমানকে।
এ ছাড়া নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলার কারণে রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন পলাতক রয়েছেন। আর খুলনার মেয়র মো. মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা রয়েছে। ‘অসুস্থতা’র কারণে এক মাস ধরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি চিকিৎসাধীন। মাঝখানে একবার খুলনায় গিয়েছিলেন।
সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, অবরোধ-হরতালে গাড়ি পোড়ানোর মামলা দিয়ে নির্বাচিত মেয়রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ফলে ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। এ সুযোগে তাঁদের জায়গায় ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্যানেল মেয়রের তালিকায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবগুলোই তো ক্রিমিনাল কেস। কতগুলো তো পরিষ্কার ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটিস। আরিফকে কিবরিয়া হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, ওখানে কিছু করার নেই। রাজশাহীর মেয়রের বিরুদ্ধে অনেক মামলা। আর গাজীপুরের মান্নান তো পুরোনো পাপী। হেফাজতের ঘটনার সময় তিনি পুলিশের ওপর আক্রমণ করেছিলেন। তাই মেয়র হোক আর যা-ই হোক, অন্যায় করলে বিচার হবেই।’
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র এম এ মান্নানকে সম্প্রতি ঢাকার বারিধারার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, এম এ মান্নানের বিরুদ্ধে যেসব মামলা করা হয়েছে, সেগুলোর অভিযোগপত্র দেওয়া হলেই তাঁকে মেয়রের পদ থেকে বরখাস্ত করা হবে। এখন অভিযোগপত্র দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
এদিকে উচ্চ আদালতের এক আদেশে আসাদুর রহমানের প্যানেল মেয়র পদ স্থগিত ছিল। গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তাঁকে বৈধ প্যানেল মেয়র ঘোষণা করেন। এর ফলে তাঁর ভারপ্রাপ্ত মেয়র হওয়ার বাধা দূর হয়েছে। ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড (টঙ্গীর পাগাড় এলাকা) কাউন্সিলর আসাদুর রহমান বিলুপ্ত টঙ্গী পৌরসভার সাবেক মেয়র আজমত উল্লা খানের ঘনিষ্ঠ। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে জানান, আপিল বিভাগের রায় তাঁর পক্ষে গেছে। গত বৃহস্পতিবার সেই রায় স্থানীয় সরকার বিভাগে জমাও দিয়েছেন। নিয়মানুযায়ী তিন প্যানেল মেয়রের প্রথমজনই ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
আজ তাঁকে মেয়রের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব অশোক মাধব রায়। রাজশাহী সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, মেয়র মোসাদ্দেক হোসেনের মামলার বিষয়ে জানতে চেয়ে করপোরেশনকে চিঠি দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিটি করপোরেশন শাখা। এই শাখা সূত্রে জানা যায়, মাস খানেকের মধ্যে রাজশাহীর মেয়র দুবার বিদেশে যাওয়ার জন্য আবেদন পাঠান স্থানীয় সরকার বিভাগে। পরে স্থানীয় সরকার বিভাগ তাঁর মামলার বিষয়ে জানতে চেয়ে রাজশাহীর পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দেয়। কিন্তু পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে এখনো কোনো প্রতিবেদন পায়নি সিটি করপোরেশন শাখা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর কমিশনার মো. শামসুদ্দিন আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোজাম্মেল হক খান প্রথম আলোকে বলেন, রাজশাহীর মেয়রের বরখাস্তের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবে সিটি করপোরেশন। মামলা থাকলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে।
কিন্তু এভাবে মামলা দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সরিয়ে দেওয়ার সমালোচনা করেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। গতকাল রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকারই তো দাবি করেছিল তাদের অধীন এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। তাহলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কেন কাজ করতে দেওয়া হবে না? তাঁর মতে, এটা খুবই অশুভ নজির। এভাবে মামলা দিলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
রাজশাহীতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেয়র হওয়ার পর মোসাদ্দেকের বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা হয়েছে। তিনি গত ২২ জানুয়ারি থেকে আত্মগোপনে আছেন। অজ্ঞাত স্থান থেকে তিনি আর্থিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন বলে সিটি করপোরেশনের একজন নির্বাহী কর্মকর্তা প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, মেয়রের বিরুদ্ধে পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ হত্যা মামলা ও বিস্ফোরক আইনে কয়েকটি মামলা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে মদদ ও নির্দেশনা দেওয়ার অভিযোগও করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হওয়ার পর থেকে তিনি ঢাকায়। সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল হান্নান বিশ্বাস বলেন, প্রশাসনিক কাজ তিনি ঢাকা থেকে করেন। প্যানেল মেয়র আনিছুর বিশ্বাস গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক ক্ষমতা মেয়র নিজের কাছেই রেখেছেন। এর ফলে সব কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা। বলা যায়, সিটি করপোরেশন চলছে না।
সিলেট সিটি করপোরেশন: সাবেক অর্থমন্ত্রী এস এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি হওয়ার কারণে বরখাস্ত হয়েছেন বিএনপি-সমর্থিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সিটি করপোরেশন শাখা সূত্রে জানা গেছে, মেয়র নেই, তাই কাজও নেই। মেয়র বর্তমানে কারাগারে।
ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্বে আছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসনিক ঝামেলা কিছুটা কমিয়ে এনেছি, বেতন-ভাতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জনপ্রতিনিধির কাজ তো আর আমি করতে পারি না।’
জানা গেছে, মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর এক ‘ক্ষমতার্পণ পত্র’-এর জোরে মেয়রের চেয়ারে বসেছিলেন প্যানেল মেয়রের দ্বিতীয় সদস্য কাউন্সিলর সালেহ আহমদ চৌধুরী। তবে মন্ত্রণালয়ের এক চিঠির বলে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেন প্যানেল মেয়রের প্রথম সদস্য কাউন্সিলর রেজাউল হাসান কয়েস লোদী। গত ৭ জানুয়ারির ওই চিঠিতেই মেয়র আরিফকে বরখাস্ত করে কয়েস লোদীকে দায়িত্ব নিতে বলা হয়। দুই কাউন্সিলরের এ লড়াইয়ে সিটি করপোরেশনে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ১১ জানুয়ারি কয়েস লোদী যখন চেয়ারে বসতে গিয়েছিলেন, তখন নিজের অনুসারীদের নিয়ে তাঁকে রুখে দিয়েছিলেন সালেহ আহমদ। পরে চেয়ার ধরে রাখতে আদালতের দ্বারস্থ হন সালেহ আহমদ। আদালত এ প্রশ্নে স্থিতাবস্থা জারি করেন।
২০১৩ সালের জুনে রাজশাহী, সিলেট, খুলনা ও বরিশাল এবং পরের মাসে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়। পাঁচটিতেই বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। এখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের টানা আন্দোলন কর্মসূচির কারণে নির্বাচিত এই মেয়রদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে এবং তাঁরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *