সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মিশ্রণে আমাদের জীবনতরী বয়ে চলে। পাওয়া -না পাওয়ার সমীকরণ চলতেই থাকে জীবনজুড়ে। কারও চাওয়া মাত্রই কাক্সিক্ষত বস্তুটি অর্জিত হয়ে যায়, কারও একটি জীবন পেরিয়ে যায় না পাওয়ার বেদনা সঙ্গী করে। এভাবেই জীবনতরী একসময় ডুবে যায় শত স্বপ্ন বুকে নিয়ে। এই যে পাওয়া-না পাওয়ার সমীকরণ, এই যে অধরা স্বপ্নের করুণ পরিণতি এ ক্ষেত্রে কালজয়ী জীবনাদর্শ ইসলাম কী বলে? শত চেষ্টার পরও যখন কাক্সিক্ষত বস্তুটি না মেলে, হতাশারা যখন মিছিল করে এসে হৃদয় জমিনকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয় স্বভাবধর্ম ইসলাম তখন আহত হৃদয়ে সান্ত্বনার প্রলেপ মাখিয়ে দেয়। প্রচন্ড দাবদাহে এক পশলা বৃষ্টি উপহার দেয়। এই যে বিপদ-আপদ একের পর এক আসতে থাকে, কখনো ভয়, কখনো ক্ষুধা, কখনো বা নানাবিধ সংকটে আমাদের জীবন বিষিয়ে ওঠে। এগুলো কেন আসে? কেন আল্লাহতায়ালা আমাদের ওপর বিপদ চাপিয়ে দেন? আল কোরআনে এর সঠিক দিকনির্দেশনা রয়েছে। বিপদ-আপদে একজন মুমিনের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে এ বিষয়ে রয়েছে কালজয়ী পথপ্রদর্শন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব (কখনো) কিছুটা ভয়ভীতি দ্বারা, (কখনো) ক্ষুধা দ্বারা এবং (কখনো) জানমাল ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। সুসংবাদ শোনাও তাদের, যারা (এরূপ অবস্থায়) সবরের পরিচয় দেয়। যারা তাদের কোনো বিপদ দেখা দিলে বলে ওঠে- আমরা সবাই আল্লাহরই এবং আমাদের তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে।’ সুরা বাকারা আয়াত ১৫৫-১৫৬। এ দুটি আয়াত থেকে আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি জীবনজুড়ে বিপদ-আপদের আগমন একজন মুমিনের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা। এসব প্রতিকূল পরিবেশে একজন মুমিন সব সময় ধৈর্যের পরিচয় দেবে। আর সবর হচ্ছে- ‘দুঃখ-বেদনা সত্ত্বেও আল্লাহর প্রতি কোনো অভিযোগ না তোলা; বরং তাঁর ফায়সালার প্রতি বুদ্ধিগতভাবে সন্তুষ্ট থাকা।’ ইবনে কাসির (রহ.) তাঁর বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ তাফসিরুল কুরআনিল আজিমে সবরের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘হজরত ওমর (রা.) বলেন, সবর দুই ধরনের। একটি হচ্ছে বিপদের সময় সবর করা। আরেকটি হচ্ছে আল্লাহর নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকার কষ্ট সহ্য করা।’ আমাদের জীবনে দুঃখ-কষ্ট একের পর এক আসতেই থাকবে। এতে বিচলিত হওয়া যাবে না। হতোদ্যম হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। বরং পাহাড়সম ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। ইস্পাতকঠিন মনোবল নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! সবর অবলম্বন কর, (ইসলামের শত্রুদের সঙ্গে) মোকাবিলার সময় অবিচলতা প্রদর্শন কর এবং সীমান্ত রক্ষায় স্থিত থাক। আর আল্লাহকে ভয় করে চল যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ সুরা আলে ইমরান আয়াত ২০০।
এভাবে জীবনজুড়ে প্রতিটি প্রতিকূল মুহূর্তে সুদৃঢ় সবরের পরিচয় দেওয়া আল কোরআনে নির্দেশনাগুলোর অন্যতম। বিভিন্ন আয়াতে সবরের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। পূর্ববর্তী অনেক ব্যক্তি ও জাতির সবর ও দৃঢ়তার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। দৃপ্তকণ্ঠে কোরআন ঘোষণা দিয়েছে, ‘যারা ইমান এনে তাকওয়ার পথে অবিচল থেকে সবরের পরিচয় দিয়েছে বিজয়মালা তাদের গলায়ই শোভা পেয়েছে। চূড়ান্ত সফলতা তাদের কপালে চুম্বন করেছে।’ তাই আসুন, আমরা সুদৃঢ় মনোবলের পরিচয় দিই। প্রতিকূল মুহূর্তে ইস্পাতকঠিন মানসিকতা প্রদর্শন করি। ধৈর্য নামক আলোকবর্তিকায় আলোকিত হয়ে দুনিয়া-আখিরাতে সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হই। আল্লাহ সবাইকে তৌফিক দান করুন।
লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর।