প্রশাসনে তীব্র সমালোচনা ডিসি পদে নিয়োগের পর ‘বাতিল’

Slider জাতীয়

এক জেলা প্রশাসকের (ডিসি) নিয়োগ আদেশ বাতিল নিয়ে প্রশাসনে সমালোচনার ঝড় বইছে। গত ৫ জানুয়ারি ১১ উপসচিবকে বিভিন্ন জেলায় ডিসি হিসেবে নিয়োগের পর ‘ছাত্রদল সংশ্লিষ্টতার’ অভিযোগে একজনের নিয়োগ আদেশ বাতিলের পদক্ষেপ এ সমালোচনা জন্ম দেয়।

যার ডিসি পদ বাতিল হচ্ছে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা-৪ শাখার উপসচিব নাফিসা আরেফীন। তাকে নীলফামারীতে ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। বিশ^বিদ্যালয় জীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন- এমন অভিযোগে তার পদায়ন বাতিল হচ্ছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। এর আগে ২০২০ সালের জুলাইয়ে মেহেরপুরে ডিসি পদে নিয়োগ পাওয়ার পর ছাত্রদল সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলামকেও পদায়ন করা হয়নি। এভাবে প্রজ্ঞাপন জারির পর ‘রাজনৈতিক তকমায়’ নিয়োগ বাতিল হওয়াকে প্রশাসনের জন্য মন্দ নজির বলে মনে করছেন সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তারা।

রাজনৈতিক কারণে নাফিসার পদায়ন বাতিল হচ্ছে কিনা- এমন প্রশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্তি সচিব (নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ) মো. আনিছুর রহমান মিঞা আমাদের সময়কে বলেন, ‘এ বিষয়ে সচিব স্যার ও মিডিয়া সেল কথা বলবে। আমার বলার এখতিয়ার নেই।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব কেএম আলী আজমকে একাধিকবার ফোন করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনও ফোনে সাড়া দেননি।

প্রজ্ঞাপনে দেখা গেছে, গত ৫ জানুয়ারি যে ১১ কর্মকর্তা ডিসি হয়েছেন তাদের ৫ জনই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। ডিসি পদে নিয়োগ পাওয়ার পর গত রবিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে তাদের ব্রিফিং হয়েছে। সেখানে নাফিসা আরেফীনকে ডাকা হয়নি। গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে নিয়োগ পাওয়া ৫ জনের ৪ জনকে অবমুক্ত করা হয়। নাফিসাকে করা হয়নি। অর্থাৎ তিনি ডিসি পদে যোগদানের সুযোগ পাচ্ছেন না। তার পদায়ন আদেশ বাতিল হচ্ছে বলে জানা গেছে।

কর্মকর্তারা জানান, নাফিসার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রদল করতেন। ধারণা করা হচ্ছে এমন অভিযোগেই তার নিয়োগ বাতিল হচ্ছে। তবে নাফিসার সহপাঠী ও অন্য কর্মকর্তারা বলছেন, তিনি দীর্ঘদিন জনপ্রশাসনে কাজ করছেন। তার মধ্যে কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়নি। তার নিয়োগ বাতিল হওয়া দুঃখজনক। এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও কোনো ব্যাখ্যা দেননি।

সূত্র জানায়, প্রজ্ঞাপন জারির পর নতুন ডিসি হওয়া কর্মকর্তাদের অভিনন্দন জানিয়ে অনেকেই ফেসবুকে পোস্ট দেন। নাফিসা ডিসি হয়েছেন দেখে ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেত্রী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে তার বিষয়ে অভিযোগ করেন। এর পরই মূলত তার নিয়োগ বাতিলের পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ডিসি পদে পদায়নের আগে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার জীবনবৃত্তান্ত যাচাই হয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো খোঁজখবর নেয়। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই ডিসি নিয়োগ হয়। এতকিছুর পরও একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারির পর ছাত্রজীবনে কোনো বিশেষ ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন- এমন অভিযোগে নিয়োগ বাতিল কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে একজন কর্মকর্তার চাকরিজীবন হুমকির মুখে পড়ে। পরবর্তী চাকরিজীবনে পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়াসহ নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। পরিবার ও সমাজের কাছেও তিনি হেয় হন। আর সরকার যদি অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শের কাউকে পদায়ন দিতে না চায়, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পদায়নের আগে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ যাছাই করা জরুরি। পদায়নের পর কারও মৌখিক অভিযোগে তা বাতিল করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়।

এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও প্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমার বিশ^াস হচ্ছে না যে একজন কর্মকর্তাকে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে পদায়নের আদেশের পর তা বাতিল করা হয়েছে। অন্য কারণও থাকতে পারে। যদি রাজনৈতিক কারণেই পদায়ন বাতিল হয়, তা হলে তা খুবই দুর্ভাগ্য। এটি কোনোভাবেই উচিত নয়। এটি প্রশাসনে মন্দ নজির সৃষ্টি করবে।’

এদিকে নতুন ১১ ডিসির মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকেই নিয়োগ পেয়েছেন ৫ জন। এতে বঞ্চিত হয়েছেন অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের যোগ্য কর্মকর্তারা। ফলে তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ডিসি নিয়োগের বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কুক্ষিগত করে ফেলেছে। ফলে মাঠ প্রশাসনে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখলেও তারা ডিসি হতে পারছেন না।

ক্ষোভ প্রকাশ করে ২৪ ব্যাচের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা মাঠ প্রশাসনে দেশের বিভিন্ন জেলায় দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ দক্ষতার মূল্যায়ন করছে না। ১১ ডিসির মধ্যে ৫ জনই একটি মন্ত্রণালয়ের। অথচ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে অনেক যোগ্য কর্মকর্তা রয়েছেন।’ এ নিয়োগে যোগ্যতার চেয়ে সিনিয়র অফিসাররা নিজস্ব ‘কোরাম’ বেশি বিবেচনা করেছেন বলে অভিযোগ তার।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘ডিসি পদে পদায়নের ক্ষেত্রে সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ফলে অন্যান্য মন্ত্রণালয়-বিভাগের অনেক দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তা বঞ্চিত হচ্ছেন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *