পৌষের প্রথম সপ্তাহেই জেঁকে বসেছে শীত। দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় এখন মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বইছে। সারা দেশে রাতের পাশাপাশি দিনের তাপমাত্রাও নেমে আসছে। হাড়কাঁপানো শীতে নাজুক হয়ে পড়েছে দরিদ্র ও শ্রমজীবি মানুষের জীবনযাপন। তীব্র কুয়াশা ও ঠাণ্ডায় মাঠের ফসল নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে কৃষকরাও। চলতি মৌসুমে দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা গতকাল রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গায় ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিভিন্ন জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদু শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে। আবহাওয়া বিভাগ জানায়, গোপালগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, নওগাঁ, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা এবং বরিশাল অঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। চলমান শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে এবং তা বিস্তারলাভ করতে পারে। পরবর্তী তিন দিনে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ সময়ের শেষের দিকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হালকা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
গতকাল চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস ও যশোরে ৭ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৪ দশমিক ২, ময়মনসিংহে ১৩ দশমিক ৩, চট্টগ্রামে ১৬ দশমিক ৪, সিলেটে ১৪ দশমিক ৪, রাজশাহীতে ৯ দশমিক ৪, রংপুরে ১১ দশমিক ৪, খুলনায় ১১ দশমিক ৬ এবং বরিশালে ৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়।
চুয়াডাঙ্গা সংবাদদাতা জানান, চুয়াডাঙ্গায় হাড়কাঁপানো শীতে বিপর্যস্ত স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বিশেষ করে ছিন্নমূল ও অতিদরিদ্র মানুষের দুর্ভোগ এখন চরমে। গতকাল চুয়াডাঙ্গায় ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। এ মৌসুমে এটিই জেলার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের দেখা মিললেও শৈত্যপ্রবাহের কারণে কমেনি শীতের দাপট। ফলে বেকায়দায় রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষ। এখন পর্যন্ত দেশের সর্বনি¤œ তাপমাত্রার রেকর্ড ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং তা গতকাল ছিল চুয়াডাঙ্গায়। চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সকাল ৯টায় জেলার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৭ দশমিক ৪ ও সকাল সোয়া ১০টায় ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা আরো কমতে পারে।
এদিকে তীব্র শীতে খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না। এতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো। গতকাল ভোরে এলাকার বিভিন্ন মোড়ে ও চায়ের দোকানের সামনে শীত নিবারণের চেষ্টায় আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নিতে দেখা গেছে নি¤œআয়ের মানুষকে। জেলা সদরের রিকশাচালক মাসুম বলেন, আজ প্রচণ্ড শীত লাগছে। ঠাণ্ডার জন্য রিকশা চালানো যাচ্ছে না। হাত ও পায়ের পাতা মনে হচ্ছে বরফ হয়ে যাচ্ছে। পেটের দায়ে বাড়ি থেকে বের হলেও প্যাসেঞ্জার পাওয়া যাচ্ছে না। বেসরকারি চাকরিজীবী শারমীন রতœা জানান, সকাল ৮টার মধ্যে অফিসের উদ্দেশে বের হতে হয়। আজ প্রচণ্ড শীতের কারণে রিকশা না নিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। যাতে শরীরটা একটু গরম থাকে কিন্তু হিমেল হাওয়ায় জবুথবু অবস্থা। অবশ্য তীব্র শীতেও হাসপাতালগুলোতে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক কম দেখা যাচ্ছে। গত তিন দিনে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে শিশুসহ প্রায় ২০০ রোগী ঠাণ্ডাজনিত কারণে আউটডোরে চিকিৎসা নেয় বলে জানান হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ডা: এ এস এম ফাতেহ আকরাম। তবে কুয়াশা ও শীত বাড়ার সঙ্গে ঠাণ্ডাজনিত রোগীর সংখ্যাও বাড়বে।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সামাদুল হক জানান, সোমবার থেকে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। থাকবে ২-৩ দিন। তাপমাত্রা আরো কমতে পারে বলেও জানান তিনি।
পঞ্চগড়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ
পঞ্চগড় সংবাদদাতা জানান, হিমালয়ের খুব কাছে অবস্থান হওয়ায় দেশের উত্তরের সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ে শুরু হয়েছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। গতকাল তেঁতুলিয়ায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কমতে শুরু করেছে সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও। গত শনিবার তেঁতুলিয়ায় দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ২৬ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর গত রোববার তা কমে রেকর্ড করা হয়েছে ২৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি। তাপমাত্রা আরো কমে এই মাসের শেষের দিকে এ অঞ্চলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ বইতে পারে বলে জানিয়েছে তেঁতুলিয়া আবহাওয়া অফিস।
এদিকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহে দুর্ভোগে পড়েছে শ্রমজীবী খেটে খাওয়া ও ছিন্নমূল মানুষগুলো। সকালে তীব্র শীত অনুভূত হওয়ায় কাজে যেতে পারছে না শ্রমজীবীরা। এরপরও পরিবারের সদস্যদের দু’বেলা খাবার আর কিস্তির টানে তীব্র শীত উপেক্ষা করেই কাজে নামছে তারা। রোববার সন্ধ্যার পর থেকে তেমনটা কুয়াশা নজরে না এলেও শেষ রাতে মাঝারি ধরনের কুয়াশায় ঢেকে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। কুয়াশা ভেদ করে গতকাল সোমবার সকাল সাতটার পরই সূর্যের দেখা মেলে। এ সময়টাতে উত্তরের কনকনে শীতল হাওয়া প্রবাহিত হওয়ায় সূর্য খুব কমই উত্তাপ ছড়ায়। দিনভর সূর্য থাকলেও কিছুক্ষণ পর পরই উত্তরের হাওয়া প্রবাহিত হওয়ায় অনেককেই রোদে দাঁড়িয়ে থেকে শরীর গরম করার চেষ্টা করতে দেখা গেছে। আর সন্ধ্যা নামতেই গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ বাড়িতে খড়কুটো জ্বেলে শীত নিবারণের চেষ্টা করতে দেখা যায় শীতার্ত মানুষকে।
পঞ্চগড় জেলায় সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৬০০ শীতবস্ত্র ও নগদ ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছে জেলা প্রশাসন। নগদ টাকায় আরো ২ হাজার কম্বল ক্রয় করা হয়েছে। যা ইতোমধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ের বিতরণ করা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। তবে নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান-সদস্যরা দায়িত্ব গ্রহণ না করায় এসব শীতবস্ত্র শীতার্তদের মাঝে বিতরণ শুরু হয়নি। আরো শীতবস্ত্র চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে জেলা প্রশাসন। তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাসেল শাহ জানান, উত্তরদিক থেকে হিমালয়ের হিমেল হাওয়া প্রবাহিত হওয়ায় ধীরে ধীরে তাপমাত্রা কমছে। আগামী কয়েক দিনে তাপমাত্রা আরো কমে এ মাসের শেষের দিকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ শুরু হতে পারে বলে তিনি জানান।
রাজশাহীতে শীতে কাহিল মানুষ
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহীতে হঠাৎ করেই তাপমাত্রার পারদ নিচে নেমে এসেছে। গতকাল রাজশাহীতে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি রাজশাহীতে চলতি মৌসুমের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা। ফলে রাজশাহীর ওপর দিয়ে বর্তমানে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে। রাজশাহী আবহাওয়া অফিস জানায়, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এ অবস্থা থেকে উন্নতির সম্ভাবনা কম। গতকাল সকাল থেকেই বইছে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। দিনভর হিমেল হাওয়ায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অনেকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। হাড়কাঁপানো শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। বিশেষ করে পথের ধারে থাকা ছিন্নমূল মানুষগুলো শীতে বেশি কাহিল হয়ে পড়েছে। এদিকে রাজশাহীর গ্রামাঞ্চল ও চর এলাকায়ও বেড়েছে শীতের তীব্রতা। এসব এলাকার মানুষগুলোকে খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করতে দেখা গেছে। শীত বাড়লেও এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে শীতবস্ত্র বিতরণ শুরু হয়নি। তবে বেসরকারিভাবে শীতবস্ত্র বিতরণ চলছে।
হঠাৎ করে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হওয়ায় তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে রাজশাহীতে। এতে কৃষিতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে শৈত্যপ্রবাহ দীর্ঘাস্থায়ী হলে কৃষকের মাঠে থাকা আলুর ফসলে লেট ব্লাইট (পচন রোগ) ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া বোরো ক্ষেতের বীজতলায় কোল্ড ইনজুরির আশঙ্কাও রয়েছে। ফলে সাধারণ কৃষকরা এখনই দুশ্চিন্তা পড়েছেন।
দিনাজপুরে শ্রমজীবিদের দুর্দশা
দিনাজপুর সংবাদদাতা জানান, দিনাজপুরে তাপমাত্রার পারদ ক্রমেই নামছে। সেই সঙ্গে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে শীতজনিত ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তীব্র শীতে জবুথবু ছিন্নমূল মানুষের দুর্ভোগও বাড়ছে। কেউ কেউ ত্রাণ তৎপরতা শুরু করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, কয়েক দিনের মধ্যে দিনাজপুরে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হবে।
আঞ্চলিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সোমবার দিনাজপুরে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত রোববার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ২ ডিগ্রি। তাপমাত্রা ৮-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ, ৬-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে মাঝারি এবং ৬ ডিগ্রির নিচে নেমে গেলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হিসেবে গণ্য করা হয়।
হিমেল হাওয়া শীতের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছে আরো কয়েকগুণ। সকালে ঘন কুয়াশা পড়ছে। এতে সড়ক ও মহাসড়কগুলোতে যানবাহনের হেডলাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। শহরের হঠাৎপাড়া এলাকার রিকশা চালক মোজাম বলেন, ‘ভোরে রিকশা নিয়ে বের হই। এই সময়টাতে রিকশা বা ইজিবাইক কম থাকে। তাই উপার্জনও বেশি হয়। কিন্তু আজ সকালে বের হয়ে দেখি রিকশার হ্যান্ডেল ধরে রাখতে পারছি না। খুব কষ্ট করে রিকশা চালাতে হচ্ছে।’
এদিকে শীত বাড়ার সাথে সাথে কৃষকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ দেখা দিয়েছে। ঘন কুয়াশায় অনেক ধরনের ফসলের ক্ষতি হয়। বিশেষ করে আলু ও টমেটোর দারুণ ক্ষতি হয়। বিরল উপজেলার দক্ষিণ রঘুনাথপুর গ্রামের পায়কাম আলী বলেন, কুয়াশা বাড়লে আলুর মড়ক দেখা দেয়। শুধু আলুই নয়, টমেটোর ক্ষেতেও মড়ক দেখা দেয়। বোরো বীজতলাতেও সমস্যা হয়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক প্রদীপকুমার গুহ বলেন, এই সময়ে কুয়াশা বা শীতের কারণে কোনো ফসলের ক্ষতি না হয়, সেজন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় বালাইনাশক ও প্রতিরোধী ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।