দেশের বাইরে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের পরিকল্পনা

কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি


মহামারী করোনা ভাইরাসের ধাক্কায় বিশ্বজুড়ে বাড়ছে খাদ্য সংকট। এ কারণে বিভিন্ন দেশে বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, করোনা সংকটে বিশ্বজুড়ে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে খাদ্যের দাম। গত দশ বছরে যা সর্বোচ্চ বলে দাবি সংস্থাটির। খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবকেই প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। এ অবস্থায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা বেগবান করার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এর অংশ হিসেবে বিদেশের মাটিতেও কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে কৃষিপণ্য উৎপাদন করা হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে কৃষিপণ্য উৎপাদনে আফ্রিকার দেশগুলোর অব্যবহৃত জমি ইজারা নিতে যাচ্ছে সরকার। সরাসরি আফ্রিকার দেশগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর জমি লিজ বা ইজারা নেওয়ার বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনা করছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।

কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে চাল, গম, পেঁয়াজ, ডাল, মসলা ও ফলমূলের মতো কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন করা হবে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত কৃষিপণ্য রপ্তানি করে অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা। জমি লিজ গ্রহণে আপাতত সরকার-টু-সরকার পর্যায়ে চুক্তি সম্পাদন করার বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। সুদানসহ কয়েকটি দেশে শিগগরি পাইলট প্রকল্প চালু করা হবে বলে জানা গেছে।

সুদান ও কেনিয়া এরই মধ্যে জমি ইজারা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতকে সম্পৃক্ত করতে নীতিগত সহায়তা দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ ছাড়া পররাষ্ট্র, বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগে একটি রোডম্যাপ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। পূর্বাচলে দুই একর জমির ওপর গড়ে তোলা হবে আন্তর্জাতিক আইএসও স্ট্যান্ডার্ডের একটি ল্যাবরেটরি। আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলোয় বিপুল পরিমাণ অব্যবহৃত কৃষি জমি রয়েছে। কিন্তু দক্ষ জনবল ও অন্য সংকটের মুখে সেখানে কৃষি জমির পুরোপুরি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশে জমি কম থাকলেও দক্ষ জনবলের ঘাটতি নেই। গত কয়েক বছর ধরে মাছ ও শাক-সবজিসহ বেশ কিছু কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। কৃষি খাতে উন্নতমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার কারণে উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। দেশের এ অর্জনে উৎপাদন বাড়াতে এবার বিদেশের ভূমিও ব্যবহার করা হবে। আগামী বছরের মধ্যে আফ্রিকার দেশগুলোয় কৃষি জমি লিজ গ্রহণ করে উৎপাদনে যেতে চায় সরকার। এ জন্য কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে এগিয়ে আসার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হচ্ছে। বিদেশের মাটিতে জমি লিজ গ্রহণ ও শ্রমিক সরবরাহসহ যে সব জটিলতার মুখোমুখি হতে হয় তা দূর করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী বাংলাদেশের অর্ধশত ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী। তারা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আবেদন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে শিগগিরই এ সংক্রান্ত বৈঠক করতে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আফ্রিকার দেশগুলোয় জমি ইজারা গ্রহণের বিষয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আন্তরিক। এ কারণেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয় থেকে এর সম্ভাব্যতা ও সমীক্ষা যাচাই-বাছাই করা হবে।

বাংলাদেশকে আফ্রিকার দেশগুলোর জমি ইজারা দেওয়ার প্রস্তাব দ্রুত যাচাইয়ে তিন মন্ত্রীকে নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে পররাষ্ট্র, বাণিজ্য ও কৃষিমন্ত্রীকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, সুদান ও কেনিয়া এখনই জমি ইজারা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এসব দেশে প্রাথমিকভাবে পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। এসব প্রকল্পে সফলতা এলে ধীরে ধীরে আফ্রিকার সব দেশে জমি ইজারা গ্রহণ করা হবে। বিশেষ করে আফ্রিকা অঞ্চলের দেশ উগান্ডা, জাম্বিয়া, তানজানিয়া, কেনিয়া, সেনেগাল, সিয়েরালিওন, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট ও ঘানায় কয়েক লাখ হেক্টর আবাদি জমি লিজ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এই জমির অর্থনৈতিক ব্যবহারে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে তা ক্রয়, ইজারা এবং বার্ষিক ভাড়াভিত্তিতে চাষাবাদ কিংবা কৃষিভিত্তিক বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে ওই সব দেশের সরকার। ইতোমধ্যে চীন, ভারত, মিসর, পাকিস্তান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এই সুযোগ লুফে নিয়ে নিজ দেশের চাহিদা অনুযায়ী সে দেশের কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্পে বিনিয়োগ করেছে। অথচ সুযোগ পেয়েও বাংলাদেশ সিদ্ধান্তহীনতা আর উদ্যোগের অভাবে নষ্ট করেছে ১০টি বছর। তবে দীর্ঘ সময় অপচয় হলেও এ বিষয়ে সরকার এখন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুুল মোমেন।

সম্প্রতি কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ওপর এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে কীভাবে এটি করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন জানান, আফ্রিকান দেশগুলোয় নিয়োজিত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষা বাহিনীর মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের জন্য ওই দেশের স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব। তিনি কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের জন্য আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নিয়োজিত শান্তিরক্ষী বাহিনীকে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বাংলাদেশে কৃষি খাতে যে উন্নতি হয়েছে সেটির সঙ্গে আফ্রিকানদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *