‘সম্পদহীন’ আইভীর ‘বিপুল’ সম্পদ, ৪০ কোটি টাকার বাড়ি নিয়ে হৈ চৈ

Slider টপ নিউজ


নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী নিজেকে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে সম্পদহীন বলে দাবি করেন। এমনকি ২০২০-২১ অর্থবছরে নিজের আয়কর রিটার্নে সম্পদ বিবরণীতেও সামান্য পরিমাণ সম্পদের কথা উল্লেখ করেন মেয়র। অন্যদিকে আয়কর রিটার্নই নেই পরিবারের বাকি সদস্যদের। তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে পুরো উল্টো চিত্র। অনুসন্ধান বলছে, আইভী তৈরি করেছেন দৃষ্টিনন্দন আলিশান বাড়ি। স্থানীয়রা যার নাম দিয়েছেন ‘হোয়াইট হাউস’। সিটি করপোরেশনের নাম ব্যবহার করেও বিভিন্ন সম্পদ দখলের উৎসব চলছে নারায়ণগঞ্জজুড়ে। বাদ যায়নি মসজিদ-মন্দিরের জমিও।

মেয়র আইভীর আয়কর রিটার্নের সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তার মোট অর্জিত তহবিল ১৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। এ ছাড়া মোট সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করেন ২৩ লাখ ৭২ হাজার ২৫০ টাকা। অথচ মেয়র আইভী ও তার ভাইবোনেরা যে বাড়িতে বসবাস করছেন, সেটি নির্মাণেই খরচ হয়েছে কমপক্ষে ৪০ কোটি টাকা। সেই সঙ্গে ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আইভী পৈতৃক সম্পত্তি থেকে ১২ শতাংশ জমির মালিকানা পেলেও সেই তথ্য তার আয়কর বিবরণীতে উল্লেখ করেননি।

আইভীর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত ২১ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানের কাছে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। এতে বলা হয়েছে, আয়কর বিবরণীতে মেয়র আইভীর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ২৪ লাখ টাকার কম হলেও বাস্তবতার সঙ্গে এর ঢের অমিল রয়েছে। হাফিজুর রহমান নামে এক ব্যক্তি অভিযোগটি করেছেন বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। এর সূত্র ধরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর স্বামী ও সন্তান দেশের বাইরে থাকেন। তাই মেয়র তার ভাইবোনদের সঙ্গেই বসবাস করেন। সম্প্রতি নতুন একটি বাড়িতে উঠেছেন তারা। আলিশান এ বাড়ির গল্প এখন নারায়ণগঞ্জের মানুষের মুখে মুখে। দৃষ্টিনন্দন এ বাড়ি যে কারোরই নজর কাড়ে। ধবধবে সাদা দেয়ালের অট্টালিকাটি নির্মাণ করতে খরচও হয়েছে বিপুল টাকা। অনেকে তাই বলছেন, সম্পদহীন দাবি করা মেয়র আইভী এখন বাস করেন আলিশান বাড়িতে। এত টাকা পেলেন কোথায়?

দুদকে দেওয়া অভিযোগে অবশ্য দাবি করা হয়, দুই ভাই ও আইভীরা তিন বোন মিলে এজমালি সম্পত্তিতে বিশাল অট্টালিকাটি তৈরি করেন। আনুমানিক খরচ হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা। বাড়ির ভেতরে যে সাজসজ্জা ও আসবাবপত্র রয়েছে, তাতেও আনুমানিক ৫ থেকে ৭ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। অথচ এ পর্যন্ত তিনি তার আয়কর নথিতে ওই সম্পত্তি অন্তর্ভুক্ত করেননি। এমনকি আইভী ছাড়া তার পরিবারের বাকি চার ভাইবোনেরও কারোর কোনো ব্যক্তিগত আয়কর বিবরণী নেই।

মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে এ ছাড়াও রয়েছে রাজ্যের অভিযোগ। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ রিক্রিয়েশন অ্যাসোসিয়েশন ভাঙার উদ্যোগ নেন তিনি। সেই সংগঠনের সঙ্গে জড়িতরা এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন। হাইকোর্টের স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ক্লাবটি ভেঙে বিশাল মার্কেট নির্মাণ করা হয়। একইভাবে নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী রহমতুল্লাহ মুসলিম ইনস্টিটিউট ভেঙে ব্যবসায়ীদের পথে বসিয়ে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ। পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখল করে রেলওয়েকে দিয়ে দিয়েছেন সিটি করপোরেশন। অন্যদিকে রেলওয়ের প্রায় ১৮ একর জমি দখল ও উচ্ছেদ করে বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম ব্যবহার করে বানিয়েছেন ‘শেখ রাসেল পার্ক’। যদিও সিটি করপোরেশনের কাগজেকলমে ওই পার্কের নাম ‘জিমখানা বিনোদন কেন্দ্র’। এক সময় রেলমন্ত্রীর পার্কটির কাজ বন্ধ করে দিলেও পুনরায় সেখানে শতকোটি টাকা ব্যয়ে নিজের ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার দিয়ে লুটপাট করেছেন।

অভিযোগে আরও বলা হয়, ৫৩৯ বছরে প্রাচীন মুঘলীয় আমলে নির্মিত মসজিদ ভেঙে ওয়াকফ এস্টেটের ৮২ দশমিক ৯০ শতাংশ জমিতে স্থাপন করেন মডেল মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর। ওই জমির বাজারমূল্য ৩০০ কোটি টাকারও বেশি। এ নিয়ে মামলা চলমান। কিন্তু জায়গা দখলের পাঁয়তারা চলছে। শুধু তাই নয়, নগরীর দেওভোগ এলাকায় লক্ষ্মীনারায়ণ আখড়া মন্দিরের অধীনস্থ ২শ বছরের পুরনো সম্পত্তি জিউস পুকুরটি ছয়টি ভুয়া দলিলের মাধ্যমে মেয়র আইভী ও তার পরিবারের সদস্যরা বহু বছর ধরে দখল করে রেখেছেন। শতকোটি টাকা মূল্যের এই দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধারে কয়েক বছর ধরে নানা আন্দোলন-কর্মসূচি করে যাচ্ছেন হিন্দু নেতারা। গত শুক্রবারও নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জজুড়ে। আদালতেও মামলা চলমান।

দুদকে অভিযোগকারী হাফিজুর রহমান বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকায় যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে। দৃশ্যত কোনো ডাস্টবিন নেই। অথচ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নামে পঞ্চবটী এলাকায় কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে কমপোস্ট প্ল্যান্ট তৈরি করা হয়, যদিও সেই প্রকল্পটি আজ ব্যর্থ। এর পরও নতুন করে ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে জালকুড়িতে নতুন প্ল্যান্ট করা হচ্ছে। এ ছাড়া সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় কয়েক কিলোমিটার বিস্তৃত খালের সৌন্দর্যবর্ধনের নামে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা লুটপাটে একটি প্রকল্প করছেন মেয়র। যেখানে খালটি নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর অধিগ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প ঢাকা সার্কুলার রুট পার্ট ২-এর অন্তর্ভুক্ত চার লেন সড়ক নির্মাণের সব পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। তাই সওজ কর্তৃপক্ষ সেখানে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ না করতে বারবার অনুরোধপত্র পাঠালেও কর্ণপাত করেননি মেয়র আইভী।’

এর বাইরে ২০১১ সালে টেন্ডার হওয়া নারায়ণগঞ্জ সিটি পাঠাগারটি (পৌর পাঠাগার) নির্মাণে ব্যয় বাড়ছে বছরের পর বছর। প্রথমাবস্থায় বাজেট ৩ কোটি টাকা থাকলেও সেটি এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ কোটি টাকায়। অভিযোগ রয়েছে, পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত গত ১৮ বছরে উন্নয়ন কাজের বেশিরভাগই করেছে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। রত্না ও মুনিয়া এন্টারপ্রাইজ নামের প্রতিষ্ঠান দুটির কর্ণধারদের সঙ্গে মেয়র আইভীর ঘনিষ্ঠতার বিষয়টিও সবাই অবগত। এমনকি মেয়রের বাড়ির পাশে সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারের অবহেলায় দেয়ালচাপায় নিহত হয়েছিলেন এক শ্রমিক। এ ছাড়া বন্দর এলাকাতে সিটি করপোরেশনের কাজে দেয়ালচাপায় শ্রমিকের মৃত্যু হলেও কিছুই হয়নি ওই ঠিকাদারদের। এসব ঘটনায় কেবল মামলা চলমান।

দুদকে লিখিত অভিযোগে হাফিজুর রহমান এও বলেছেন, জাতীয় সংসদের পঞ্চম অধিবেশনে ২০১৫ সালের ৪ মার্চ একজন সংসদ সদস্য তারকা চিহ্নিত প্রশ্নের (১৬৫৯ ও ৭৭৪) উত্তরে সিটি করপোরেশন কর্তৃক অসত্য, অসম্পূর্ণ ও ভুল তথ্য দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন। পরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল এসব অভিযোগের তদন্ত করতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়। সেই কমিটি দীর্ঘ ও সরেজমিন তদন্তের পর ২০১৫ সালের ১০ আগস্ট ২৪৮ পাতার একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। সেখানে সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে আনা বেশ কয়েকটি অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে ওই বছরের ২৭ আগস্ট স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, সমবায় মন্ত্রণালয়ের (স্থানীয় সরকার বিভাগ) সিটি করপোরেশন-০২ শাখা দুদক সচিব বরাবর চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে চলমান তদন্তের কোনো সুরাহা হয়নি।

মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে অভিযোগকারী হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র কয়েকটি অনিয়ম আর দুর্নীতির কথা দুদকে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করেছি। যেমন ধরেন, চলতি বছরেও সিটি করপোরেশনের ভেকু, সার্ভেয়ার, লোকবলসহ মেয়র আইভীর আপন ভাইয়ের নেতৃত্বে সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবীর জমি দখল করা হয়েছে। বসতবাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে।’ তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে গতকাল সন্ধ্যায় ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *