ঢাকা: সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তিন ধাপে আড়াইশ চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত এবারের নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও আওয়ামী লীগসহ প্রায় ২০টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ছিল। এর মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সব চেয়ারম্যানই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন, যার মধ্য দিয়ে পাঁচ বছর আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল।
নির্বাচনে দাপট দেখাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। সদ্যসমাপ্ত দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনেও প্রায় এক তৃতীয়াংশ চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৪৮৬ চেয়ারম্যান প্রার্থী জয়ী হন। এছাড়া স্বতন্ত্র ৩৩০, জাতীয় পার্টি ১০, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ চার এবং জাতীয় পার্টি (জেপি), খেলাফত মজলিস ও জাসদ একটি করে ইউপিতে জয়ী হয়েছে।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউপি ভোট হয়। সেবার ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২১২ জন চেয়ারম্যান পদে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এতদিন সেটাই ছিল সর্বোচ্চ। এবারের তিন ধাপের নির্বাচনেই সেই রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বাকি ধাপে আরও বেশি সংখ্যক প্রার্থীকে বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন তারা। এবারের নির্বাচনে তিন ধাপে সংরক্ষিত নারী ও সধারণ সদস্য পদে ৮১৭ জন বিনা ভোটে জয়ী হয়েছেন।
ইসি কর্মকর্তারা জানান, তৃতীয় ধাপে চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন দলের ১০০ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া সাধারণ সদস্য পদে ৩৩৭ জন এবং নারী সদস্য পদে ১৩২ জন নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। এর আগে দ্বিতীয় ধাপে চেয়ারম্যান পদে ৮১ জন, সংরক্ষিত সদস্য পদে ৭৬ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে ২০৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। আর প্রথম ধাপে চেয়ারম্যান পদে ৬৯ জন, সাধারণ সদস্য পদে ৬৩ জন এবং সংরক্ষিত সদস্য পদে ৬ জন ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হন। আগামী ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপে ১০০৪ ইউপিতে ভোট হবে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ছিল গত বৃহস্পতিবার।
নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ পরিচালক যুগ্ম সচিব এসএম আসাদুজ্জামান জানান, তৃতীয় ধাপে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন ৫০ হাজার ১৪৬ প্রার্থী। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে চার হাজার ৪০৯ জন, সাধারণ সদস্য পদে ৩৪ হাজার ৬৩২ জন ও সংরক্ষিত সদস্য পদে ১১ হাজার ১০৫ জন প্রার্থী ভোটের লড়াইয়ে রয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, ভোট ছাড়াই নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করতে প্রার্থীদের অনেকে নানা ‘কৌশল’ খাটাচ্ছেন, সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব, পেশিশক্তি ও অর্থের প্রভাবও থাকছে। এ সমালোচনার মধ্যে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও সম্প্রতি দলের মনোনীত প্রার্থীদের হুশিয়ার করেন। তিনি বলেন, অপকর্ম করলে কেউ রেহাই পাবে না- শাস্তি তাদের পেতেই হবে। ছলে বলে কৌশলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ নির্বাচিত হলে শৃঙ্খলাবিরোধী অপকর্ম বলে গণ্য করা হবে।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৫ ইউপিতে ভোট হয়। ভোটের পরের দিনও সব ইউপির ফল সংগ্রহ করে একিভূত করা সম্ভব হয়নি বলে আমাদের সময়কে জানিয়েছেন ইসির যুগ্ম সচিব এসএম আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, সব জায়গা থেকে এখনো ফল পাওয়া যায়নি। এ নির্বাচনেও প্রায় এক তৃতীয়াংশ স্বতন্ত্র প্রার্থী জয় পেয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আমাদের সময়ের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুসারে, দ্বিতীয় ধাপের চেয়ারম্যান পদে ডুমুরিয়ায় ১৪ ইউনিয়নের মধ্যে দুটিতে নৌকা জয় পেয়েছে। বাকি ১২ ইউনিয়নে জিতেছে স্বতন্ত্র প্রার্থী। কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীর ৭ ইউনিয়নে নৌকা ২, লাঙল ৩, হাতপাখা-১ ও একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আওয়ামী লীগ ৬, বিদ্রোহী ৫ ও স্বতন্ত্র ৩ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ভেড়ামারায় ৩ ইউপিতে নৌকা ২টিতে এবং ১টিতে জাসদ প্রার্থী জয় পেয়েছেন। ধামরাইয়ে আওয়ামী লীগ ৮টিতে এবং ৭টিতে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলায় নৌকার একজন এবং স্বতন্ত্র দুজন এবং বিএনপিপন্থি হয়েছেন। নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার ৮ ইউনিয়নের মধ্যে ৫ ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। কুষ্টিয়ার মিরপুরে ১১ ইউনিয়নের মধ্যে নৌকা ৫টিতে ও বাকি ছয়টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন। পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার সাতটি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত দুজন, ‘বিদ্রোহী’ তিনজন ও বিএনপিপন্থি নির্বাচিত হয়েছেন। ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৬ জন ও বিদ্রোহী ৬ জন জয় পেয়েছেন। পিরোজপুরের ৩ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে নৌকা ৪, সতন্ত্র প্রার্থী ৩ এবং জাতীয় পার্টির (জেপি, মঞ্জু) ১ জন নির্বাচিত হয়েছেন।
নরসিংদীর রায়পুরায় ১০ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা জিতেছে ৪টিতে। ৬টিতে জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ীর ১৬ ইউনিয়নের মধ্যে ১৪টির ফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৯টিতে নৌকা প্রতীকের জয় হয়েছে। বাকিরা স্বতন্ত্র প্রার্থী।
শরীয়তপুর সদর উপজেলায় ৯টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ৪টি ও বিদ্রোহী প্রার্থীরা ৫টিতে জয় পেয়েছেন। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ৯ ইউনিয়নে নৌকার চারজন ও স্বতন্ত্র পাঁচজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
সিলেট বিভাগে ৪৪টি ইউনিয়নে বৃহস্পতিবার ভোট হয়। এতে নৌকা প্রতীক নিয়ে জয় পেয়েছেন ৯ জন। ২৩ ইউনিয়নে জয়ী হয়েছেন ‘বিদ্রোহীরা’। ১ টিতে খেলাফত মজলিসের প্রার্থী জয়ী হন।
টাঙ্গাইলের তিন উপজেলার ১৮ ইউনিয়নের মধ্যে ১৩টিতে নৌকার প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। বাকি পাঁচটি জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ৭ ইউনিয়নের মধ্যে দুটিতে নৌকা, তিনটিতে জাতীয় পার্টির লাঙল, একটি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (হাতপাখা) ও একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। রংপুরের ২ উপজেলার ১৮ ইউনিয়নের মধ্যে ১১টিতে আওয়ামী লীগ, ৬টিতে স্বতন্ত্র ও ১টিতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
করোনা মহাকারীকালে প্রথম থাপে গত ২১ জুন অনুষ্ঠিত ভোটে ২০৪ ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৪৮টিতে এবং ৪৯টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে জয়ী হন। গত ২০ সেপ্টেম্বর একই ধাপের বাকি ১৬০ ইউপিতে ভোট হয়। এর মধ্যে ১৩১টিতে বিজয়ী হন নৌকার প্রার্থীরা। ২৯টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পান। প্রথম ধাপের মোট ৩৬৪ ইউপির মধ্যে ২৭৯টি নৌকা ও ৭৮টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয় লাভ করেন।
দেশে প্রায় সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। ধাপে ধাপে ভোটের মাধ্যমে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন উপযোগী সব ইউপির ভোট শেষ করার পরিকল্পনা করেছে ইসি।