ঢাকাঃ ডিজেলের দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ভাড়ার হার পুনর্নির্ধারণ করে সরকার। বাসভাড়া ২৭ ভাগ বাড়লেও পরিবহনকর্মীরা আদায় করছে ৫০ শতাংশ বর্ধিত হারে। এটি ঠেকাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু করে। রাজধানীতে্ আটটি চট্টগ্রামে দু্টি মোবাইল কোর্ট চলে গতকাল। যদিও এতে করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় রোধ করা যাচ্ছে না। কর্তৃপক্ষের কিছুটা আন্তরিকতা থাকলেও সক্ষমতার অভাবে বাড়তি ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। উল্টো পরিবহন খাতের বিরাজমান অবস্থা নিয়ে আজ সংবাদ সম্মেলন করার কথা।
এদিকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের মহাপরিদর্শক, বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, সব জেলার প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে গতকাল চিঠি দিয়েছে বিআরটিএ। ডিজেলচালিত বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের দুই দিন পর গতকাল পূর্ণাঙ্গ ভাড়ার তালিকা তৈরি করলেও তা এখনো ওয়েবসাইটে দেয়নি। দৃশ্যমান স্থানে ‘ভাড়ার তালিকা’ লাগানোর আইন থাকলেও গতকাল পর্যন্ত তা কোনো বাসে দেখা যায়নি।
সরকারের তরফ থেকে ভাড়া নির্ধারণের কিছু হুশিয়ারির খবর আসে। অতিরিক্ত ভাড়া নিলে কঠোর ব্যবস্থার কথা বলছেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কখনো তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। একে পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার সক্ষমতা ও আন্তরিকতার অভাব হিসাবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাসমালিকদের বাড়তি ভাড়া আদায়ের প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়নি। বিপুল পরিমাণ বাসের বিপরীতে গতকাল ঢাকায় আটটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ২৫৭টি বাসের কাছ থেকে দুই লাখ ৮৩ হাজার ৫০০ জরিমানা আদায় করেছে বিআরটিএ। এর মধ্যে কত জরিমানা অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কারণে করা হয়েছে তা জানাতে পারেনি সংস্থাটি। সেপ্টেম্বর মাসে দুই হাজার ৩০৪ মামলায় ৩৩ লাখ ৯৬ হাজার ১০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। দেশে ৪৯ হাজার বাস ও ২৭ হাজার মিনিবাসের নিবন্ধন রয়েছে। এর মধ্যে চলাচলরত বাস-মিনিবাসের সংখ্যা কম। তবু বিপুল পরিমাণ বাসের বিপরীতে বিআরটিএর মাধ্যমে অভিযান পরিচালনার বাস্তবসম্মত সক্ষমতা নেই। এর আগে দেখা গেছে, নতুন ভাড়া কার্যকরের পর কিছুদিন অভিযান চলে। যাত্রী ও পরিবহনকর্মীদের বাগবিতন্ডার একপর্যায়ে বাসমালিকদের ইচ্ছার জয় হয়। এবারও এর ব্যতিক্রম কতটুকু হবে দেখার বিষয়।
সরকার নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় এবং যাত্রী ভোগান্তি থেকে বিরত থাকার জন্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের আহ্বান জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল তিনি বলেন, অন্যথায় দায়ী পরিবহনের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা।
ওবায়দুল কাদের জানান, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। দেশব্যাপী অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, হাইওয়ে পুলিশ, জেলা পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আবারও মালিক ও শ্রমিক নেতাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ভাড়া আদায়ের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘অন্যথায় সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে।’ ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কিছু কিছু গণমাধ্যম দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করলেও দু-একটি গণমাধ্যম বিরূপ ও অপমানজনক সমালোচনা করছে, যা প্রত্যাশিত নয়। অন্যদিকে কেউ কেউ পাতানো খেলা বলছে, অনেকেই আঁতাতের গন্ধও খুঁজে পেয়েছেন উল্লেখ করে সেতুমন্ত্রী বলেন, ‘যাত্রীকল্যাণ সমিতি নামে একটি ভুয়া সংগঠনও বিষয়টি না জেনে, না বুঝে সমালোচনা করছে।’
ওবায়দুল কাদের প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘তা হলে পরিবহন ধর্মঘট অব্যাহত থাকলে সেটা কি জনগণের জন্য কল্যাণকর হতো? মন্ত্রী মনে করেন, ‘যাত্রী ভোগান্তি কমাতে অতীতের ধারাবাহিকতায় গণমাধ্যমের মূল্যবান পরামর্শ আমাদের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।’
গতকাল রাজধানীসহ সারাদেশের খবর নিয়ে দেখা গেছে, বাসভাড়া ৫৬ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি করে আদায় চলছে। নগর পরিবহনে সর্বনিম্ন ভাড়া ১৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে কিছু পরিবহনে। এতে করে অনেকের মাসের খরচে টান পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল সকালে বিআরটিএ ভাড়ার চার্ট সরবরাহ করেছে পরিবহন মালিকদের কাছে। নিয়মানুযায়ী, ভাড়ার চার্ট দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শিত থাকতে হবে। কিন্তু নগরীর কয়েকটি বাসে চড়ে কোথাও চার্ট এর দেখা মেলেনি। কিলোমিটার অনুযায়ী দূরত্বভেদে পুনর্নির্ধারিত ভাড়ার হার দেখে পরিশোধের সুযোগ পাচ্ছেন না যাত্রীরা। গতকাল পর্যন্ত ‘ভাড়ার তালিকা’ বিআরটিএর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। ফলে পরিবহনকর্মীদের দাবি করা ভাড়াই মানতে হচ্ছে যাত্রীদের।
অতিরিক্ত ভাড়া নিলে কিংবা গাড়ির হালনাগাদ কাগজ না থাকলেও সড়ক পরিবহন আইনানুযায়ী গাড়ির মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে বিআরটিএ’র। দায়ী পরিবহনের রুট পারমিট, নিবন্ধন বাতিলের ক্ষমতাও বিআরটিএকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরাসরি মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নজির খুবই কম। ২০১৫ সালের অক্টোবরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সাজার প্রতিবাদে সড়কে বাস রেখে ঢাকা অচল করে দেওয়া হয়েছিল। কর্মকর্তারা জানান, সে কারণে চাইলেও অনেক কিছু করা যায়নি।
বিআরটিএ’তে অনুমোদিত ৮২৩টি পদের ১২১টি শূন্য রয়েছে। সংস্থাটি জনবল বাড়িয়ে তিন হাজার ৮২০ জন করার প্রস্তাব করা হয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৩১৫টি পদ বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করে। কিন্তু সবশেষ অর্থ মন্ত্রণালয় ৯৬টি পদ বৃদ্ধি অনুমোদন করেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের সীমানার বাইরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় ম্যাজিস্ট্রেট নেই। চট্টগ্রামে ৩১ মামলায় সাড়ে ৪১ হাজার টাকা জরিমানা।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, ডিজেল চালিত পরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত এবং সিএনজিচালিত পরিবহনে বেশি ভাড়া আদায়ের বন্ধে চট্টগ্রাম নগরীরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে বিআরটিএ। গতকাল নগরীর বিভিন্ন এলাকায় দুজন নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট এ আদালত পরিচালনা করেন। এদিন ৩১টি মামলায় সাড়ে ৪১ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। বিআরটিএ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একিমিত্র চাকমা ও শাহরিয়ার মুক্তার আদালত পরিচালনা করেন। নগরীর ২ নম্বর গেট, জিইসি মোড়, টাইগারপাস, পোলোগ্রাউন্ড এলাকায় অভিযাতে নেতৃত্ব দেন একিমিত্র চাকমা। এসময় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অপরাধে ১২টি মামলায় ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহরিয়ার মুক্তার নগরীর বায়েজিদ, বহদ্দারহাট, চকবাজার, আন্দরকিল্লা, বাকলিয়া এলাকায় অভিযান পরিচালনা একই অপরাধে ১৯টি মামলায় ২১ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করেন।