ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কৃষিতে। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন দেশের লাখ লাখ কৃষক। এর প্রথম ধাক্কা লাগবে আসন্ন বোরো আবাদে। শুধু তাই নয়, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে দেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সরকারের যে চেষ্টা সেখানেও ব্যাঘাত ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে হলেও কৃষক ও কৃষিকে সচল রাখার দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে সামগ্রিকভাবে কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে পরিবহনভাড়া বাড়িয়েছে সরকার। কৃষি উৎপাদন ঠিক রাখতে কৃষককে ডিজেলে ভর্তুকি দেয়া জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশের বেশির ভাগ এলাকায় আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। চলছে বোরো ধানের বীজতলা তৈরির কাজ। আর কিছুদিনের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের জমিতে সেচ দেয়া শুরু হবে। এ সেচ দেয়ার যন্ত্রের (পাওয়ার টিলার) প্রধান জ্বালানি ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারে ১৫ টাকা। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সদস্য পরিচালক (ক্ষুদ্র সেচ) মো: জিয়াউল হক নয়া দিগন্তকে জানান, দেশে মোট কৃষকের সংখ্যা এক কোটি ৯৭ লাখ ৭৯ হাজার ৭৮ জন। এর মধ্যে সেচযন্ত্রের আওতায় এক কোটি ৯৪ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭২ জন। শুধু ডিজেল সেচভুক্ত এক কোটি ২৩ লাখ ৫৯ হাজার জন কৃষক রয়েছেন। বছরে সেচ বাবদ প্রায় ১০ লাখ মে. টন ডিজেলের প্রয়োজন পড়ে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) বলছে, প্রতি বিঘা জমিতে সেচ ও চাষ দিতে দরকার ২০ লিটার ডিজেল। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে এ বছর কৃষকের বিঘাপ্রতি ৩০০ টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে। এতে তার মুনাফাও প্রায় ৩ শতাংশ কমে যাবে। এবারের বোরো মৌসুমে কৃষকের সেচ বাবদ বাড়তি খরচ হবে ৭৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে কৃষকের ধানের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। সার ও কীটনাশকের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কৃষিশ্রমিকের মজুরিও বাড়ছে। সব মিলিয়ে প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ বছরে বাড়ছে এক থেকে দুই টাকা করে। সরকারি হিসাবে, গত মৌসুমে বোরো ধানের কেজি-প্রতি উৎপাদন খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মণ ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় এক হাজার ৮০ টাকা। এবার সেচের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাড়তি চাপ তৈরি করবে। সামগ্রিকভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) জানায়, দেশে ধান ছাড়াও কৃষির অন্য খাতেও সেচযন্ত্রের দরকার হয়। যেমন শীতকালীন সবজি, পুকুর ও ঘেরে মাছ চাষে সেচযন্ত্রের ব্যবহার হয়। জমি চাষ থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহন, নৌযান চালানোর মতো কাজে সারা বছর শ্যালো মেশিনের ব্যবহার হয়। এসব যন্ত্র ডিজেলনির্ভর। ব্রি’র হিসাবমতে, শুধু ধান রোপণ বা চাষাবাদে নয়, মাড়াই, পরিবহনের কাজেও ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন ব্যবহৃত হয়। ধান ছাড়াও নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত রবি মৌসুমে শীতকালীন সবজি, গম, ভুট্টাসহ প্রধান ফসলগুলো উৎপাদিত হয়। বৃষ্টিহীন এ মৌসুমে সেচ ছাড়া ফসল উৎপাদন সম্ভব নয়। নদী, সাগর ও জলাশয়ে মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত নৌকার জ্বালানি হিসেবেও ডিজেল ব্যবহৃত হয়। সব মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে সব ধরনের কৃষিপণ্যের ওপরে ডিজেলের এ মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, এ বছর ৪৮ লাখ ২০ হাজার হেক্টর (তিন কোটি দুই লাখ ৯১ হাজার বিঘা) জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এর ৭০ শতাংশ বা ৩৩ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর (দুই কোটি ৫২ লাখ ২০ হাজার বিঘা) জমিতে সেচ দেয়া হবে ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র দিয়ে। এ হিসাবে কৃষককে বাড়তি খরচ গুনতে হবে ৭৫৬ কোটি ৬১ লাখের বেশি টাকা। বাকি ৩০ শতাংশ জমিতে সেচ দেয়া হবে বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্র দিয়ে। এমনিতেই ডিজেলচালিত সেচযন্ত্র ব্যবহারে কৃষকদের উৎপাদন খরচ বেশি। এবার বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্র ব্যবহার করা কৃষকদের সাথে তাদের খরচের পার্থক্য আরো বেড়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে উৎপাদিত ধানের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে বোরো মৌসুম থেকে। আগামী মৌসুমে দুই কোটি ৯ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধিতে সর্বপ্রথম এই বোরো আবাদে বড় ধাক্কা লাগবে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কৃষি বিভাগকে এই ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খেতে হবে। এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: আসাদুল্লাহ বলেন, ডিজেলের দাম বাড়ানোর ফলে বোরো আবাদেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চেষ্টা করছি। সরকার তো সার-বীজে ভর্তুকি দিচ্ছে, যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি দিচ্ছে। ডিজেলের বিষয়টিও সরকার ভাববে আশা করি।
বিএডিসি’র সদস্য পরিচালক (ক্ষুদ্র সেচ) মো: জিয়াউল হক বলেন, ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে শুধু বোরো বা সেচে নয়, সামগ্রিকভাবে কৃষিতে প্রভাব পড়বে। কারণ পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর ও হারভেস্টার ক্ষেতে নিতে ডিজেলেরই প্রয়োজন পড়ে। ধান রোপণ, ধান কাটা, ধান ঝাড়াতে লাগবেÑ সবকিছুতেই ডিজেলের যন্ত্র ব্যবহৃত হয়। তিনি বলেন, ২০১০ সালে কৃষককে সেচে যে ভর্তুকি দেয়া শুরু হয়েছিল, এখনো চলছে। সেচযন্ত্র তথা বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। এখন যেহেতু সবে ডিজেলের দাম বাড়ানো হলো, আমরা কৃষিমন্ত্রীর সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করব। এর বাইরে তিনি পানির অপচয়রোধসহ সেচ পদ্ধতিতে পরিবর্তন ও আধুনিকায়ন জরুরি বলে মত দেন। তিনি বলেন, এতে পানি কম লাগবে, খরচ কমানো সম্ভব।
নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্য সফরে কৃষিমন্ত্রী : কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, ইউরোপের বাজারে সতেজ শাকসবজি, ফলমূল ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যের রফতানি এবং পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে সরকারি ও বেসরকারি শিল্পোদ্যোক্তাদের একটি প্রতিনিধিদল নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাজ্য সফরে যাচ্ছে। ১৫ সদস্যের প্রতিনিধিদল গতকাল সোমবার রাতে নেদারল্যান্ডসের উদ্দেশে রওয়ানা হন। পরে নেদারল্যান্ডস থেকে ১৩ নভেম্বর যুক্তরাজ্যে যাবে। এ সফরে প্রতিনিধিদল নেদারল্যান্ডস এবং যুক্তরাজ্যের কৃষি ও খাদ্যবিষয়ক বিভিন্ন সরকারি দফতর/সংস্থার প্রধান, শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, চেইনশপের সাথে আলোচনা করবে। একই সাথে দেশে কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাত বৃদ্ধি করতে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ফার্ম, গবেষণা সেন্টার, অ্যাক্রিডিটেশন ল্যাব, সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি প্রভৃতি পরিদর্শন ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করবেন। আগামী ১৮ নভেম্বর প্রতিনিধিদলের দেশে ফেরার কথা রয়েছে।