ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের ধর্মঘটের মধ্যেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাড়তি ভাড়া দিয়ে পণ্য সরবরাহ করেছে পাইকার ও আড়তদার। ধর্মঘট প্রত্যাহার হলেও ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে পণ্য পরিবহনে যে খরচ বাড়বে তা কৃষককে বহন করতে হবে। সেই টাকা ভোক্তাদের কাছ থেকেই তুলে নেবেন বিক্রেতা। অর্থাৎ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে বাজারে যে প্রভাব পড়ছে তার জন্য কৃষক ও ভোক্তাকে ভুগতে হবে। অবশ্য ধর্মঘটের কারণে বাজারে বেড়ে গেছে সবজির দাম। তবে দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য সরবরাহ করতে না পেরে অনেক কৃষককে লোকসান গুণতে হবে।
ভাড়া সমন্বয়ের পর বাস চালু হলেও ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের ধর্মঘট প্রত্যাহারের ব্যাপারে গতকাল পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সঙ্গে মালিক সমিতির আলোচনা চলছিল। তবে বৈঠকে বসার আগেই দুপক্ষ সমাধানের পথ খুঁজে পেয়েছে। সমাধান যা-ই হোক, পণ্য পরিবহনে ট্রাক ভাড়াও যে বাড়ছে তা নিশ্চিত বলা যায়।
ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ধর্মঘটে পণ্য পরিবহন ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে উল্লেখ করে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে সবজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স রিয়াদ এন্টারপ্রাইজের ব্যবসায়ী বলরাম চন্দ্র জানান, ধর্মঘটের মধ্যে এ বাজারে অন্যান্য পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা কমলেও সবজির ট্রাক আগের মতোই আসছে। তবে স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা কম। কিন্তু যেসব ট্রাকে পণ্য আসছে, সেগুলোয় ভাড়া অনেক বেশি পড়ছে। তিনি আরও বলেন, সবজি ঢাকায় নিয়ে আসার ট্রাকই পাওয়া যাচ্ছে না। পরিচিত ট্রাকে অনেক দরদাম করে পণ্য আনতে হচ্ছে। ট্রাকপ্রতি দুই থেকে সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া দিতে হচ্ছে আমাদের। এর পরও ট্রাক মিলছে না।
বলরাম আরও বলেন, পরিবহন ব্যয় বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই পাইকারি পর্যায়ে সবজির দামও বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব খুচরা বাজারেও পড়ছে। অথচ এ সময় সবজির দাম কমতে থাকার কথা। কারণ এখন দিন যত যাবে শীতের সবজির সরবরাহও বাড়বে। কিন্তু ট্রাক-কাভার্ডভ্যানের ধর্মঘটের কারণে সেটা হচ্ছে না। উল্টো দাম বাড়ছে।
গতকাল কারওয়ানবাজারে সবজি কিনতে এসে বেসরকারি চাকরিজীবী মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, শীত চলে এসেছে। বাজারে শীতের সবজির সরবরাহও বাড়ার কথা। এখন কোথায় একটু কম দামে সবজি কিনে খাব তা না- উল্টো দুই দিনে লাফিয়ে বেড়ে গেছে সবজির দাম। আমরা করোনার ক্ষতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। অথচ এমন একটা সময়ে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে সরকার পরিবহন মালিকদের ভাড়া বাড়ানোর সুযোগ করে দিল। এতে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ও গরিবদের জীবনধারণের কষ্ট কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ সবজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকার বেশি। গত দুদিনে ফুলকপি, বরবটি, কচুর লতি, টমেটো, গাজরসহ বেশকিছু সবজির দাম বেড়েছে। কারওয়ানবাজারের খুচরা দোকানেই বরবটি, কচুর লতির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা। ঢেঁড়সের কেজি ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। শিমের কেজি ৮০ থেকে ৯০ টাকা। পাকা টমেটোর কেজি ১১০ টাকা। চিচিঙ্গা, ধুন্দল ও মুলার দামও চড়া। নতুন করে আলুর দাম কেজিতে দুই টাকা বেড়ে কারওয়ানবাজারে বিক্রি হচ্ছে ২২ টাকায়। প্রতিপাল্লা (পাঁচ কেজি) ১১০ টাকা। অন্যদিকে এ বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা দরে। রাজধানীর মালিবাগ, মধুবাগসহ অন্য বাজারে এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি দামে। সব বাজারেই ব্যবসায়ীদের একই ব্যাখ্যা- পরিবহন খরচ বেড়েছে। তাই দামও বাড়তি।
কারওয়ানবাজারের সবজি সরবরাহকারী আরেক প্রতিষ্ঠান মেসার্স ওয়াছি বাণিজ্যালয়ের ব্যবসায়ী মো. বিল্লাল হাওলাদার বলেন, সবজি পরিবহনের খরচ তো বেড়ে গেছে ধর্মঘটের শুরু থেকে। বাড়তি ভাড়া দিয়েও ট্রাক পাওয়া যাচ্ছে না। এতে সবজি আনতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে আমাদের।
চুয়াডাঙ্গা, বগুড়া, শেরপুর, ময়মনসিংহ, যশোর, মেহেরপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজধানীতে সবজি আমদানি করে থাকে ওয়াছি বাণিজ্যালয়। বিল্লাল বলেন, বগুড়া থেকে রাজধানীতে পণ্য আমদানিতে বস্তা (৮০ থেকে ৯০ কেজি) প্রতি ৩০ টাকা খরচ বেড়েছে। আগে যেখানে বস্তাপ্রতি পরিবহন খরচ ১২০ থেকে ১৩০ টাকা ছিল, এখন সেখানে খরচ করতে হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা পর্যন্ত।
আরেক পাইকার হান্নান ব্যাপারীও বলেন, বগুড়া থেকে রাজধানীতে পণ্য আমদানিতে আগে ট্রাকপ্রতি ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা ভাড়া ছিল। দুদিন ধরে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক রুটেই বাড়তি ভাড়া গুনতে হচ্ছে আমাদের।
দাম বাড়ার কথা অস্বীকার করে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি মো. তোফাজ্জল হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, রাজধানীতে প্রতি রাতে ২৫ হাজারেরও বেশি পণ্যবাহী ট্রাক ঢোকে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবিকা। ডিজেলের দাম বাড়ায় ট্রাক মালিক ও সংশ্লিষ্টরা বিপদে পড়েছেন। আমরা শক্ত অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছি। তবে রাজধানীর বাজারগুলোয় পণ্যবাহী ট্রাক ঢুকছে। কোথাও ট্রাক ভাড়া বাড়ানো হয়নি। শুরু দিকে কোথাও কোথাও বেশি ভাড়া রাখা হলেও বর্তমানে বাড়তি ভাড়া রাখা হচ্ছে না। আমরা আজ (সোমবার) রাতে সরকারের সঙ্গে বৈঠকে বসব। সেখান থেকে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এদিকে বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা তিন দিনের ধর্মঘটে ব্যাপক লোকসানে পড়েছেন জেলার কৃষকরা। আমাদের সময়ের মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, প্রতিদিন জেলার ৬টি উপজেলা থেকে আগাম শসা, পুঁইশাক, লালশাক, লাউশাক, উচ্ছে, ধনিয়া পাতা, বেগুন রাজধানীর বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি করে পাইকাররা। টানা তিন দিনের ধর্মঘটে জমি থেকে শসা ও উচ্ছে পরিপক্ব অবস্থায় উত্তোলন করতে না পারায় বেশি অংশ নষ্ট হয়ে গেছে। এতে কৃষকরা ব্যাপক লোকসানে পড়েছেন।
শহরের চরকিশোরগঞ্জ মোল্লাপাড়া এলাকার কৃষক মনির হোসেন মোল্লা বলেন, দশ গন্ডা জমিতে শসা ও ৬ গন্ডা জমিতে লাউ লাগিয়েছি। লাউয়ের কোনো ক্ষতি না হলেও শসা নষ্ট হয়েছে অনেক। শসা নিয়ম অনুযায়ী জমি থেকে না উঠালে নষ্ট হয়। পাইকাররা আসতে পারে নাই।
নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, ট্রাক ধর্মঘটের প্রভাব পড়েছে নরসিংদীর সবজির বাজেরও। সঠিক সময়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সবজি পাঠাতে না পেরে একপ্রকার বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। বেশি ভাড়া দিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সবজি পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন পাইকাররাও।
শিবপুর উপজেলার আব্দুর রহমান নামে এক পাইকারি ক্রেতা বলেন, পরিবহন ধর্মঘটের কারণে ঢাকায় বেশি ভাড়া দিয়ে সবজি পাছিয়েছি। ফলে আমাদের খরচ বেড়ে গেছে। যদি বিকল্পভাবে ঢাকায় সবজি পাঠাতে না পারতাম, তা হলে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতাম।