দারুণ বুদ্ধি পরিবহন মালিকদের। এ বুদ্ধির জোরেই তারা জয়ী হয়েছেন। এখন মুখে তাদের তৃপ্তির হাসি। রাতের আঁধারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়া তাদের জন্য সাপে বর হয়েছে। আমজনতার পকেট কাটার লাইসেন্স পেয়েছেন তারা। এমনিতেই জনতার বেহাল দশা। ঘর থেকে বেরুলেই মাথা ঘুরে। বাজারে গেলে মুখ কালো হয়ে যায়।
দামের আগুনে কলিজা পুড়ে। কাউকে কিছু বলার নেই। আজ থেকে আবার যোগ হলো বাড়তি ভাড়ার খড়গ। এত যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আমজনতা কাহিল। গণপরিবহন মালিকদের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ভাড়া বাড়ার দাবিতে অঘোষিত ধর্মঘটে চলে যান। অথচ জনগণের কথা চিন্তা করলে তারা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানাতে পারতেন। এ জন্য ধর্মঘটে যেতে পারতেন। আম পাবলিক এতে অন্তত খুশি হতেন। তাদের জন্য প্রার্থনা করতেন। আসলে পৃথিবীটাই উল্টো হয়ে গেছে। সোজা পথে কেউ হাঁটে না। পাবলিক গুমরে কাঁদছে। এ কান্না দেখার কেউ নেই। কতো টাকা বেড়েছে বাস-মিনিবাসের ভাড়া? বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দূরপাল্লার বাসে প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি ভাড়া বেড়েছে ৩৮ পয়সা। আর মহানগরে প্রতি কিলোমিটারে বেড়েছে ৪৫ পয়সা।
এ ছাড়া বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা, মিনিবাসে ৮ টাকা। বাসের সঙ্গে লঞ্চে কিলোমিটার প্রতি ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৩৫ শতাংশ। তার মানে ঢাকা থেকে কুমিল্লার দূরত্ব ৯০ কিলোমিটার। আগে ভাড়া নন-এসি ছিল ২০০ টাকা। এখন গুনতে হবে প্রায় আড়াইশ’ টাকা। গুলিস্তান থেকে ফার্মগেটের ভাড়া ছিল ১০ টাকা। এখন তা দাঁড়াবে ১৩ টাকার বেশি। কিন্তু বাসের সুপারভাইজার গতরাত থেকেই নেয়া শুরু করেছে ১৫ টাকা। অথচ গেজেট হওয়ার পর এ ভাড়া কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। এমনিতেই বেতনের টাকা থেকে সরকারকে আয়কর দিতে হয়। যে বাড়ি বানায় তার ট্যাক্স দিতে হয়। বিদ্যুৎ বিল দেবো সেখানেও ভ্যাট দিতে হয়। আপনজনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বললেও দিতে হচ্ছে কর। অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে দিতে হয় মোটা অঙ্কের ফি। আগে যে ডাক্তার ফি নিতেন ৫০০ টাকা। বর্তমানে সেই ডাক্তারকে দিতে হয় হাজার টাকা। রিপোর্ট দেখাতেও দিতে হয় ৫/৬শ’ টাকা। কারণ ডাক্তারও যে আয়কর দেন। সে আয়কর তো উঠাতে হবে রোগীর কাছ থেকেই। ওষুধ কিনতে গেলাম সেখানেও ভ্যাট সংযুক্ত করে সিরাপ, ইনজেকশন, ইনসুলিন, ক্যাপসুল ও ট্যাবলেটের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে ধরিয়ে দিচ্ছে বিল। যেখানে সংযুক্ত করা হচ্ছে ভ্যাট। সেটাও দিতে হয়। কোথাও বেড়াতে যাব। খালি হাতে কীভাবে যাই। মিষ্টির দোকানে গেলাম। এখানেও একই অবস্থা-ভ্যাটসহ দিতে হচ্ছে বিল। শুধু কি তাই? না! যে কোনো প্যাকেটজাত পণ্য কিনতে কোনো স্টোরে গেলে সেখানেও একই অবস্থা। ভ্যাটসহ দাম নির্ধারণ করা আছে। সেখানেও দিতে হচ্ছে উপরি টাকা। শিশু গুঁড়োদুধ খায়। ভ্যাট ছাড়া এই দুধ কেনা কার সাধ্য আছে? আজও একটি শার্ট কিনতে হলো ৪% ভ্যাট দিয়ে। ওদিকে কথা নেই, বার্তা নেই বাড়িওয়ালা এসে হাজির। গ্যাসের দাম ৯৫০ টাকা হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বাড়বে। আগামী মাস থেকে ৩০০০ টাকা করে বেশি ভাড়া দিতে হবে। কিছু বললে উত্তর আসে- আপনার মনে চাইলে থাকুন। নাহলে চলে যান। কোথায় যাব? সরকার নতুন করে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখেছে অনেক দিন। শত শত বাড়িতে চলছে এলপি গ্যাস দিয়ে রান্না। দুই বছর আগে বাইশ কেজির এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের দাম ছিল ১৮০০ টাকা। বাড়তে বাড়তে এখন তার দাম হয়েছে ২৬০০ টাকা। বাড়তির এতো চাপ নিতে পারছে না মানুষ।
গ্রামে বসবাস করবো? তাতে কি? একটি ঘর থাকলেই ইউনিয়ন পরিষদ থেকে খাজনার অঙ্ক জানিয়ে দেবে। তা পরিশোধ করতেই হবে। ভাবছি বিদেশ যাবো। বিমানের টিকিট কেনার সময়ই সরকারের কর কেটে নেবে তিন হাজার টাকা। এখানেও খেতে হলো ধাক্কা। একজন মানুষকে এমনভাবে করের নেটওয়ার্কে বাঁধা হয়েছে তার আর নড়াচড়ার উপায় নেই। বাংলাদেশে একজন মানুষ বসবাস করতে তার নিত্যদিন কতো টাকা ভ্যাট, ট্যাক্স দিতে হচ্ছে? তার হিসাব কষলে মাথা ঘুরে যায়। আয়ের টাকা ভ্যাট আর ট্যাক্সের পেছনেই যদি ঢালতে হয়, তাহলে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার উপায় থাকলো কোথায়?
আরও আছে- হঠাৎ হঠাৎ সিন্ডিকেটের উৎপাত। চাল, তেল, ডাল, আদা, পিয়াজ, রসুন সিন্ডিকেট ফণা উঁচু করে দাঁড়ায়। এ ফণা নামানোর কেউ নেই। এতে দংশন হয় আমজনতা। বিষে নীল হয়। আহ, উহ্ করার সাহস পর্যন্ত নেই। এবার যোগ হলো বাস ভাড়া সিন্ডিকেট। তিনদিন জনগণকে পায়ের তলায় পিষে এখন জয়ের হাসি হাসছে। আর অসহায় জনতা নীরবে কষ্ট বুকে চেপে দিন পার করবে। এটাই হয়তো নিয়তি।