বিদেশগামীদের টিকাদান ও কোভিড নেগেটিভ সনদ নিয়ে রাজধানীজুড়ে রমরমা বাণিজ্যের তথ্য পাওয়া গেছে। যার পেছনে জড়িত দালালদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। অভিযোগ আছে, প্রবাসীকল্যাণ ভবন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সরকারি ল্যাব থেকে আইসিটি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানেই রয়েছে এই চক্রের যোগাযোগ। তারা টাকার বিনিময়ে কিছু বিদেশগামীকে সরবরাহ করছে কোভিড-১৯ পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট ও টিকা গ্রহণের সনদ। ইতোমধ্যে এ ধরনের প্রতারণার ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি জিডি হয়েছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ দল এরই মধ্যে প্রতারণায় জড়িত ৩ জনকে গ্রেপ্তারও করেছে। তার পরও থেমে নেই এই চক্রের তৎপরতা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিদিন ঢাকা থেকে আরব আমিরাতগামী ৬টি ফ্লাইট রয়েছে। এসব ফ্লাইটে গড়ে প্রায় ১২শ যাত্রী দেশ ছাড়েন। এসব যাত্রীর বেশিরভাগই প্রবাসী। যথাসময়ে কাজে যোগদানে তাদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে দেশটিতে যেতে হলে অবশ্যই কোভিড নেগেটিভ সনদ এবং দুই ডোজ টিকাগ্রহণের সনদ প্রয়োজন। এ ছাড়া ইউরোপের দেশগুলো বা যুক্তরাষ্ট্র যেতে হলেও একই ধরনের সনদ দরকার হয়। আর এই সুযোগটিকে কাজে লাগাচ্ছে প্রতারক চক্র। ভুয়া কোভিড নেগেটিভ ও টিকার সনদ সরবরাহ করে তারা দৈনিক হাতিয়ে নিচ্ছে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারল সেন্টারে (এনআইএলএমআরসি) কর্মরত এক চিকিৎসক এবং একজন টেকনোলজিস্ট আমাদের সময়কে বলেন, সরকারিভাবে বিদেশগামীদের করোনা পরীক্ষা এখানে করা হয়। সময়স্বল্পতার পাশাপাশি যদি কেউ করোনা পজিটিভ হয়ে যায়, তা হলে তার বিদেশে কর্মস্থলে ফেরা কঠিন হয়ে যায়। এই স্পর্শকাতর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ চক্র বিদেশগামী শ্রমিকদের কাছ থেকে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ কাজে ল্যাবরেটরি টেকনোলজিস্ট, ড্যাটাঅ্যান্ট্রি অপারেটর এবং দালালরা জড়িত।
জানা গেছে, এমন একটি প্রতারণার ঘটনায় গত ২৮ অক্টোবর এনআইএলএমআরসির পক্ষ থেকে শেরেবাংলা নগর থানায় জিডি করা হয়। প্রতিষ্ঠান পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ এহসানুল হক স্বাক্ষরিত ওই জিডিতে বলা হয়েছে, তাদের প্রতিষ্ঠানে বিদেশগামীদের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়। যার নমুনা আর্মি স্টেডিয়ামে সেনাবাহিনী কর্তৃক সংগ্রহ করে পাঠানো হয় এই প্রতিষ্ঠানে। পরে এখানে পরীক্ষার পর রিপোর্ট দেওয়া হয়। গত ২৭ অক্টোবর এক বিদেশগামী যাত্রীকে টাকার বিনিময়ে কোভিড পজিটিভ রিপোর্টকে নেগেটিভ করে দেবেন মর্মে ০১৭৯৫-৪৪৩৪৮০ নম্বর থেকে এক ব্যক্তি যোগাযোগ করেন। যে ব্যক্তি এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি নিজেকে এনআইএলএমআরসিতে কর্মরত বলে দাবি করেছিলেন। যদিও দপ্তরের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এনআইএলএমআরসিতে কর্মরত কেউ ওই নম্বর ব্যবহার করেন না। এ অবস্থায় ওই ব্যক্তিকে শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়। এ বিষয়ে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ এহছানুল হক বলেন, জিডি করা হলেও থানা থেকে এখনো কোনো অগ্রগতির বিষয়ে তাদের জানানো হয়নি। এ প্রসঙ্গে শেরেবাংলা নগর থানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, জিডি বিষয়ে এসআই পলাশকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি আমাদের সময়কে জানান, তারা তদন্তের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছেন।
এনআইএলএমআরসিতে কর্মরত একাধিক চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা বলছেন, অনেকেই তাদের কাছে ফোন করে এ ধরনের বিষয়ে জানতে চান। এর পরিপ্রক্ষিতে অফিসের কেউ ওসব নম্বর ব্যবহার করে কিনা তারা খুঁজে দেখেছেন। এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায়ও অনুসন্ধান করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কারও নম্বরের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, জনৈক এমডি কায়সার নামে এক ব্যক্তি সম্প্রতি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, দুই ঘণ্টার ভেতরে টিকার সনদ দেওয়া হয়। এসএইচ বেলাল উদ্দিন নামে আরেক ব্যক্তি তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, যারা ই-পাসপোর্ট অথবা এমআরপি অ্যাপ দ্বারা টিকার নিবন্ধনে ব্যর্থ হয়েছেন কিংবা ৭২ ঘণ্টার পরও বিবেচনাধীন আছেন, ইনশাল্লাহ ১০ থেকে ২০ মিনিটে তাদের নিবন্ধন সম্পন্ন করে দেওয়া হবে। এমডি রোমান হোসেন নামে আরেকজন তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ইমার্জেন্সি টিকা লাগবে কেউ হেল্প করতে পারবেন? এর প্রত্যুত্তরে এমডি শাকিল ভূইয়া নামে জনৈক ব্যক্তি লিখেছেন, তিনি যেন ইনবক্সে যোগাযোগ করেন।
সরেজমিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস ও পুরাতন ভবনের আশপাশে, ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের সামনে, প্রবাসীকল্যাণ ভবনের আশপাশে এমন অসংখ্য দালাল ছড়িয়ে আছেন। যারা মানুষদের ডেকে ডেকে জানতে চান টিকা সনদ বা কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট লাগবে কিনা। মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পুরাতন ভবনের সামনে কথা হয় ‘খান’ নামের এমন একজনের সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, যেখানে যাবেন, যে দেশে যাবেন কোনো সমস্যা নেই। শুধু পাসপোর্ট আর ভিসার ফটোকপি দিলেই হবে। টিকা সনদ, কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট সবই পাবেন। কোথাও কোনো সিরিয়াল দিতে হবে না, লাইনে দাঁড়াতে হবে না। শুধু এর জন্য গুনতে হবে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। তিনি একটি মোবাইল নম্বরও প্রতিবেদককে দেন।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে গিয়েছেন মো. নূর নামের এক শিক্ষার্থী। যথাসময়ে প্রয়োজনীয় টিকাগ্রহণ ও যাত্রার আগে করোনা পরীক্ষা নিয়ে তিনি জটিলতায় পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে তাকে সহযোগিতা করেন জাকির নামে এক দালাল। নূরকে টিকার সনদ ও কোভিড নেগেটিভ সনদ পাইয়ে দেওয়ার জন্য জাকির দাবি করেন ৩০ হাজার টাকা। শেষ পর্যন্ত ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে সবকিছু রফা হয়। বাংলাদেশ ছাড়ার আগে নূর জানান, অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হলেও দালাল তার কথামতো সব কাজ যথাসময়ে করে দিয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে কথা হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি আগেই জেনেছেন। বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় ইতোমধ্যে ৩ জনকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এসব প্রতারণার সঙ্গে মূলত একটি অসাধু চক্র জড়িত- যারা আইসিটি বিভাগের সহায়তায় এই কাজটি করেন। তিনি সবাইকে এই চক্রের থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।