গাজীপুর: ভাবনাগুলো ডাল পালা মেলে দেয় সব সময়। স্বপ্নের মহীরুপে ভাবনার ডাল পালা যখন ভর করে, প্রকৃতির লতা পাতা তখন লজ্জায় মিলিয়ে যায়। প্রকৃতির মহিরুহ ভাবনার আবরণে কৃত্রিম স্বপ্ন তৈরি করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা কল্পনাকে মাঝে মধ্যে ধূলোয় মিশিয়ে দেয়। প্রকৃতির এই মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কাছে ভাবনা বা স্বপ্নের পাহাড় যে তুচ্ছ তা বাস্তব হলেও মানতে নারাজ। মানুষের দেহ এবং মনের সংঘর্ষ চিরায়ত। মানুষ বয়স মানতে চায়না। বয়স বাড়ে কিন্তু মন নারাজ। মনের বয়স কমে, দেহের বয়স বাড়ে। দেহ ও মনের সংঘর্ষে একদিন মানুষ বিলিন হয়ে যায়। সুতরাং মানব জীবনের পুরোটা সময় দেহ ও মনের সংঘর্ষ চলে। এই সংঘর্ষ থেমে যায় তখন, যখন মানুষ নিরাকা হয়। । হয়ত এই জন্যই বাড়তি বয়সের কাউকে বয়সের কথা জিজ্ঞাস করলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চায়। ৯০ বছরের বৃদ্ধও বিয়ে করতে চায়। ৯০ বছরের বৃদ্ধাও বিয়ের কথা শুনলে মুসকি হেসে অবচেতন মনে ক্ষনিকের জন্য যৌবনে ফিরে সম্মতি দিতে চায়। মানুষ ও প্রকৃতির এই চিরায়ত খেলা ভঙ্গ হয়না কিন্তু সাঙ্গ হয়। এটাই নিয়তি।
পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশ। রক্ত আর ইজ্জ্বত মিশ্রিত মানচিত্র ও জাতীয় পতাকা। অর্জনে বিসর্জন আর বর্জনের ইতিহাস মাঝে মাঝে ভূলে যেতে চাই আমরা। সমাজ থেকে রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রেই যে কোন মূল্যে প্রাপ্তীর উন্মাদনা, পতাকার রং আর মানচিত্রের ধরণ ক্ষতি হউক আর না হউক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর ভর করে ক্ষমতা চাই আমরা। চেতনার লালন পালন ও সংরক্ষণে খেয়াল থাকেনা আমাদের। চলন্ত ট্রেনের গাড়ি চালক হতে চায় সবাই ইঞ্জিনের পেছনে বগি আছে বা নাই তাকানোর সময় নাই আমাদের। স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতন্ত্র নিয়েও উদাসীন আমরা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার মন্ত্র শুধু ভুলেই যাইনা আমরা ক্ষমতার প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি খুনের ঘটনা ঘটাতে দ্বিধা নেই আমাদের। স্বপরিবারে রাষ্ট্রপতি খুন কিংবা শুধুই রাষ্ট্রপতিকে খুন করে লাশ গুম করার অভিজ্ঞতাও আছে আমাদের। এ সবই ক্ষমতার জন্য বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, ক্ষমতায় আসার জন্য । যে জীবনে একদিনও রাজনীতি করেনি তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারেও বসেছেন। জোড় করে ক্ষমতা দখল, সামরিক সরকার, তত্বাবধায়ক সরকার সৈরাচারী সরকার, এ সবই আমাদের গণতন্ত্রের তকমা । আর এই তকমা লাগিয়ে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া আসা করছি আমরা। কাউকে আজ রাজাকার বলছি কালকে তাকেই নিয়ে সরকার গঠন করছি। আজ যাকে স্বৈরাচার বলছি কাল তাকে নিয়ে সরকার গঠন করছি। পাওয়া না পাওয়ার প্রয়োজনে হলুদ গণতন্ত্রের আবরণে মিশে যাচ্ছে নূর হোসেন ও ডাক্তার মিলনেরা। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠ করতে গিয়ে ভোটার খুন করছি, ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ক্ষুধার্থ মানুষকে গুলি করে মারছি। এ সবই আমারে গণতান্ত্রিক নমুনা। জনগনের সামনে সাধু সাজছি ,ঘরের ভিতরে নরঘাতক হচ্ছি এগুলো আমাদের কারো কারো চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। এ সবই আমাদের তকমা তন্ত্রের ফসল।
ত্রয়ী পরজীবী । সাধারণত পরের উপর নির্ভরশীল জীব বা প্রাণিকে জীব বিজ্ঞানের ভাষায় পরজীবী বলা হয়। পরজীবীরা নিজে অর্জন করে না । অন্যের অর্জনের উপর ভর করে বাঁচে। বাংলাদেশে সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষনে এক বাক্যে বলা যায় গণতন্ত্র এখন পরজীবী। জীবন যুদ্ধ রক্ত আর সম্ভ্রম এই সবের বিনিময়ে আমাদের চলমান গণতন্ত্র । কথা আর কাজ দুটোই যেন পরজীবীর উপকরণ। নিজে বাঁচার জন্য অন্যকে মেরে বাঁচতে চাই আমরা। কবরস্থানে যেতে চাই লাশ দাফনের অংশ নিতে। কিন্তু দাফন হতে হবে, মানতে নারাজ। শ্মশানে যায় মানুষ পোঁড়া দেখতে , কিন্তু আমাকেও পোঁড়া হবে মানতে যেন ভয়ংকর বাঁধা। মনুষ্য সৃষ্টির কাল্পনিক এই সকল কর্মযজ্ঞ বাস্তবতাকে উড়িয়ে দিতে চায় ওই দূর সীমানায়। আমরা মারতে চাই, মরতে চাইনা, মানে মরতে হবে বুঝতে চাইনা। মিথ্যার আবরণে সৃষ্ট মহীরুহে উঠে বসে থাকি সবসময় । ভাবীনা মহীরুহও ধ্বংস হবে। এটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
পরজীবী। গাছই পরজীবী এটাই শুধু নয় মানুষও পরজীবী হয়। অন্ধ মানুষ, চোখে দেখা মানুষের হাত ধরে ভিক্ষা করে এই দৃশ্য চিরায়েত। পরজীবী ভিক্ষুক কর্মট মানুষের হাত ধরে চলে কিন্তু মানতে নারাজ। আমরা অনেকেই পরজীবী কিন্তু ভিক্ষুক নই। একটি খবরে পড়েছিলাম ত্রয়ী পরজীবী নির্মাণ কাজে ত্রিশংকু অবস্থা। খবরে বলা হয়েছিল টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ ও তদ্বিরবাজ এই তিন শ্রেণির পরজীবীদের দৌড়াত্বে নির্মান খাতে ত্রিশংকু অবস্থা। ১৯৯২ সনে প্রকাশিত এই খবরের বাস্তবতা ২৮ বছরে এর পরিধি বাড়িয়ে দিয়েছে। ত্রয়ী পরজীবীর দৌড়াত্বে এখন বাংলাদেশেরই ত্রিশংকু অবস্থা। বাংলাদেশটাই যেন ত্রয়ী পরজীবীর হাতে জিম্মি। ব্যাবসা করার জন্য রাজনীতি, ব্যবসা করার জন্য সাংবাদিকতা, অপরাধ করে আত্মরক্ষা করার জন্য রাজনীতি যেন ফ্যাশন হয়ে গেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাজনীতি এখন পালাতে চায় । পরজীবীর রাজনীতি যেন বাহাসে উল্লাস করতে চায়। ক্ষমতা আর অর্থের প্রয়োজনে সব কিছু বিসর্জন দিয়ে রাজনীতির কাঁধে ভর করার মানুষিকত এখন প্রবল । ফলে রাজনীতিবিদ ও পরজীবী রাজনীতিবিদদের মাঝে সংঘর্ষ চলমান। রাজনীতিতে জীবি আর পরজীবির প্রতিযোগিতায় দিন দিন পরজীবীরা এগিয়ে চলছে। রাতারাতি আদর্শ পরিবর্তন করে প্রতিস্থাপিত হওয়ায় প্রকৃত রাজনীতিবিদরা এখন কোনঠাসা। ফলে ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মী এখন রাজনীতি করতে লজ্জা বোধ করে। রাজনীতি বিদদের হাতে রাজনীতি ফিরে না আসলে পরজীবী রাজনীতিবিদদের সৃষ্ট রাজনীতি একদিন গণতন্ত্র ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনাত ও সার্বভৌমত্বকে গিলে ফেলতে পারে, এমন ধারণা ও আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবেনা ।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ পরিচালনায় খাঁটি রাজনীতিবিদদের সুসংগঠিত হওয়া খুবই জরুরী হয়ে গেছে। না হয় পরজীবী রাজনীতিবিদদের কবলে পরে আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি, সেনাার বাংলাদেশ এক সময় স্মৃতি হয়ে যেতে পারে।
লেখক
রিপন আনসারী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী