বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল বেশকিছু বিনাধানের জাত কৃষি অর্থনীতিতে এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। সুষম খাদ্য ও শস্য উৎপাদনে এক বিপ্লব ঘটতে পারে। এতে দেশের বিশাল খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণ হবে। দূর হবে দরিদ্রতা। বিনার কয়েকটি উচ্চ ফলনশীল আগাম স্বল্প জীবনকাল ধানের জাত চাষ করে এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব। বেশকিছু বিনাধান চাষি ও বিনার বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য মিলেছে। শুধু প্রয়োজন বিনার বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত জাত ও প্রযুক্তিগুলো কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়া। কৃষকদের দোর গোড়ায় পৌঁছে দিতে পারলেই এই লক্ষ্য পূরণ সম্ভব।
বিনাধানের জাতগুলো চাষ করে লাভবান হওয়ায় বিনাধান চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের। চাষিদের মাঝে এসব জাতের ধানের বীজ উৎপাদন ও সরবরাহের দায়িত্ব নিতে হবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বীজ বিভাগকে। চাষিদের এ ধানের আবাদ সম্প্রসারণে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ। বিনা উদ্ভাবিত কয়েকটি ধানের জাত শুধু দেশজুড়ে নয়, বিদেশেও জনপ্রিয়তা লাভ করছে। বর্তমান ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব ধানের চাষাবাদ হচ্ছে।
সারা দেশে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫.৭৭ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে আমন চাষ হয় ৫৫.৮৩ লাখ হেক্টর জমিতে। উল্লিখিত জমিতে স্বল্পকালীন আগাম বিনাধানের চাষ করে অনায়াসে সরিষাসহ বিভিন্ন রবিশস্য অনায়াসে চাষাবাদ করা যায়। বিনা সরিষা-৯ জীবনকাল মাত্র ৮০-৮৪ দিন। এর ফলন প্রতি হেক্টরে ২ টন। কমপক্ষে ৩০.৫০ লাখ হেক্টর সরিষা চাষ করলে কৃষি অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. মিজানুর রহমান বলেন, বিনাধান-১৬ ও বিনাধান-১৭ একটি স্বল্প জীবনকাল উচ্চ ফলনশীল আগাম ধানের জাত। কৃষকদের মাঝে এই জাতগুলো ছড়িয়ে দিতে পারলে কৃষক একটি বাড়তি ফসল পাবে। তাদের আয় বাড়বে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমন মৌসুমে বিনাধান-১১, বিনাধান-১৬ বিনাধান-১৭ ও বিনাধান-৭ চাষ করে একই জমিতে কমপ েতিন থেকে চারটি ফসলসহ আবাদ করা সম্ভব। এতে করে কৃষকদের আয় বাড়বে। চলতি বছরে ময়মনসিংহসহ সারা দেশে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে এই ধানটি চাষ করা হয়েছে। আগামী দিনে এই ধানের জাত সকল অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়ার কথা ভাবছেন কৃষি বিভাগ। এই জাতগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতি বছর বিএডিসি (বীজ) অফিসে বীজের জন্য দৌড়াতে হয় না। একবার চাষ করলে উৎপাদিত ধান থেকে বীজ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এক চাষি থেকে আরেক চাষি বীজ ধান সংগ্রহ করতে পারছে।
রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকার বিনাধান চাষি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান মকবুল হোসেন জানান, এ বছর ১০ একর জমিতে তিনি আগাম জাতের বিনাধান-৭, বিনাধান-১১ ও বিনাধান-১৭ চাষ করেছেন। এই জাতগুলো উদ্ভাবনের পর থেকে তিনি চাষাবাদ করে আসছেন। ফলনও ভালো পাচ্ছেন। আগাম আমন ধান কেটে এই জমিতে বিনা সরিষা ও আলুসহ বিভিন্ন রবিশস্য আবাদ করেন। তিনি বলেন বছরে অনায়াসে ৩ থেকে ৪টি ফসল আবাদ করা যায়। তিনি আরও বলেন, বিনার আগাম জাতের ধান চাষ করে তিনি দ্বিগুণ লাভবান হচ্ছেন। তার ভাগ্য পরিবর্তন দেখে আশপাশের চাষিরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। এ সময় মঙ্গা এলাকা হিসেবে বদনাম ছিল তা এখন আর নেই।
চাষি মশিউর রহমান মন্টু বলেন এ বছর তিনি ৩ একর জমিতে বিনার আগাম ৩টি জাতের ধান চাষ করেছেন। বিনাধান চাষে কম সময়ে ফসল ঘরে তোলা যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, লেবার খরচ কম, সার, কীটনাশক ও পানি কম লাগে। ধানের দাম ও খড়ের দাম বেশি পাওয়া যায়। ফলে বেশি ফলনশীল ধান কাটতে একমাস বেশি সময় লাগে। যার ফলে বিনাধান চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভ হচ্ছি আমরা।
রংপুর হাজীরহাট মন্থনা গ্রামের চাষি মিজানুর রহমান বলেন, তিনি এবছর ১ একর ৭ শতাংশ জমিতে আগাম বন্যা সহিষ্ণু বিনাধান-১১ চাষ করেছেন। ফলনও ভালো হয়েছে। এই ধানের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। চাষাবাদে খরচ কম। আগাম পাকার ফলে বিনা সরিষা-৯ চাষ করব। পরবর্তীতে ভুট্টা এবং বোরো আবাদের পরিকল্পনা রয়েছে। এই ধান দেখে অন্য চাষিরা বীজ সংগ্রহের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বিনার রংপুর উপকেন্দ্রের ইনচার্জ ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আলী বলেন, স্বল্প সময়ে ফসল পাওয়া যাওয়ায় বিনাধান জাতগুলো চাষে কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে। চাষিদের চাহিদা অনুযায়ী বীজ ও প্রযুক্তি তাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে কৃষি অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটবে।
ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার বড়গ্রাম ইউনিয়নের কোনাগাঁও কেজাইকান্দা গ্রামের কৃষক হেলাল উদ্দিন বিনার বিজ্ঞানীদের পরামর্শে ত্রিশ শতক জমিতে বিনাধান-১৭ চাষ করেছেন। কৃষক হেলাল জানান, অন্যান্য জাতের ধানের এখনো থোড় না হলেও বিনা-১৭ ধান পেকে গেছে। ফলনও ভালো হয়েছে। এতে অল্প সময়ে ধান পাকা দেখে এলাকার অনেক কৃষক অবাক হয়েছে। এই গ্রামের কৃষক কৃষিবিদ একেএম আজিজুল হক দুদু বলেন, ৫২ শতক জমিতে বিনা-১৭ চাষ করেছি। ধান কাটা শেষ। এখন সরিষা চাষ করবো। বোরো মৌসুম শুরুর আগেই সরিষা কাটা হয়ে যাবে। ফলে একটা ফসল অতিরিক্ত পাবো। এটা আমার জন্য বাড়তি লাভ হবে। বিনা-১৭ ধানের চাষের জন্য এলাকার অনেক কৃষক পরামর্শ নিচ্ছেন। আশা করা যাচ্ছে কয়েক বছরের মধ্যে এটি বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। এই গ্রামের আরেক কৃষক সোমাইমান মিয়া বলেন, এমন অল্প সময়ে ধান পাকতে কখনো দেখিনি। আমাদের এলাকায় এটাই প্রথম। আগে জানলে আমিও চাষ করতাম। তবে আগামী মৌসুমে এই ধানের আবাদ করবো।
কুমিল্লা দক্ষিণ সদরের নলকুড়ি গ্রামের কৃষক আবদুল মমিন বলেন, বিনাধান-১৭ চাষ করে লাভবান। ধানটা আগাম হওয়ায় কাটার আগেই ৬ হাজার টাকার খড় বিক্রি দিয়েছি। ধান কেটে সরিষা চাষ করবো। বিনাধানটা চিকন, খেতে সুস্বাদ। তাই ৪ বছর ধরে বিনাধান চাষ করছি। কুমিল্লা আদর্শ সদরের আম্রতলীর চাষি রিপন মিয়া বলেন, বিনাধান-২১ কেটে বিনাধান-১৬ রোপণ করেছি, নভেম্বরে বিনাসরিষা-৯ করবো। সরিষা তুলে বিনাধান-১৪ আবাদ করবো। স্বল্পকালীন হওয়াতে এক বছরে একই জমিতে ৪টি ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। আমার জমির ফলন দেখে অনেকেই আগামীতে বিনাধান চাষের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার পুথাই গ্রামের কৃষক বিল্লাল হোসেন বলেন, স্বল্প জীবনকাল বিনাধান চাষ করে তিনি বাড়তি সরিষাসহ রবিশস্য চাষ করছেন। ফলে আশেপাশের চাষিরা এই ধান চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তারা বীজ হিসেবে ধান কিনে নেয়ার জন্য তারা আমাকে আগাম বলে রেখেছেন।
কুমিল্লার বিনা উপকেন্দ্রের ইনচার্জ ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আশিকুর রহমান বলেন, বিনাধান-১৬ ও ১৭ স্বল্প জীবনকালীন আগাম জাত হওয়ায় ১৫ই অক্টোবরের মধ্যে ধান কেটে বাড়তি রবিশস্য করতে পারছে চাষিরা। ফলে কৃষকের লাভবান হচ্ছে। কুমিল্লা, চাঁদপুর ও বাহ্মণবাড়ীয়া জেলায় এই জাতের ধানের চাষাবাদ বাড়ছে। এ অঞ্চলে এবছর এসব জাতের ৫ টন বীজ বিক্রি করা হয়েছে। যা দিয়ে ৩শ’ একর জমি ধান চাষাবাদ করা হয়েছে।
জামালপুর বন্যা কবলিত এলাকা। এখানে বন্যা সহিষ্ণু আমন ধানের বিনাধান-১১ চাষ হয়। মেলান্দহ উপজেলার চাষি জিয়াউল হক বলেন তার জমিগুলো নিচু বর্ষাকালে পানিতে ডুবে যায়। বিনাধান-১১ চাষ করলে ১৫-২০ দিনে পানির নিচে থাকলেও পচে না। দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার দিঘলকান্দি গ্রামের চাষি বিকাশ চন্দ্র সাহা বলেন, আমন মৌসুমে প্রতি বছর বন্যার পানিতে আমাদের ধানের জমি তলিয়ে যায়। বিনাধান-১১ চাষ করলে ২০-২৫ দিনে পানির নিচে থাকলেও পচে না। এই ধানটা স্বল্প জীবনকালীন হওয়ায় দু’ফসলি জমিতে ৩টা ফসল অনায়াসে করা যায়। বাড়তি ফসল বিনা সরিষা-৯ চাষ করা যায়। শেরপুরের কৃষক আনোয়ার হোসেন জানান, স্বল্প জীবনকাল বিনাধান-১১ ও ১৭ চাষ করে একই জমিতে ৩/৪টি ফসল করছেন। ফলে তারা লাভবান হচ্ছেন। আরেক কৃষক বলেন আগে বছরে আমরা দুটি ফসল করতে পারতাম বিধাধান করে আমরা ৩/৪টি ফসল করে লাভবান হচ্ছি।
জাতিসংঘসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ৮টি পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী, স্বল্প জীবনকাল বিনাধান-১১, ১৬ ও ১৭ সহ বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল ফসলের ২৫টি জাতের উদ্ভাবক ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, সাধারণত স’ানীয় জাতের আমন ধানের জীবনকাল ১৬০-১৭০ দিন এবং গাছ লম্বা হওয়ায় ঢলে পড়ে। দীর্ঘ জীবনকাল বিশিষ্ট হওয়ায় উত্তরবঙ্গসহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চলের কৃষকরা বছরে দু’টির বেশি ফসল চাষ করতে পারে না। তাই গবেষণার মাধ্যমে আমন মৌসুমের জন্য উচ্চ ফলনশীল ও স্বল্প জীবনকাল বিশিষ্ট বিনাধান-১১, ১৬ ও ১৭ ধানের জাত আবিষ্কার করা হয়েছে। বিনাধান-১১, ১৬ ও ১৭ এর জীবনকাল বীজতলা থেকে ১০০-১১০ দিন এবং গড় ফলনও ৬.৫ টন/হেক্টর (বিঘাপ্রতি ২৭ মণ)।
বিনাধান-১১, ১৬ ও ১৭ এর উদ্ভাবক আরও বলেন, বিনাধান কাটার পর বিনা সরিষা-৯ আবাদ করে দুই ফসলি জমিতে তিনটি ফসল অনায়াসে আবাদ করা যায়। এই ধানটি রোগ বালাই সহনশীল, এক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া সার ও অর্ধেক পানি সাশ্রয়ী এবং খরা সহিষ্ণু হওয়ায় আগাম ও অধিক ফলনশীল বিনাধান-১৭ কে ‘গ্রিন সুপার রাইস’ বলা হয়। এই ধানটি ‘মেগা ভ্যারাইটি’ হবে বলেও জানান এই বিজ্ঞানী।
তিনি আরো বলেন, বিনা উদ্ভাবিত জাতগুলো চাষ করে চাষিরা লাভবান হচ্ছে শুনে অনেক ভাল লাগে। আমি মনে করি এতে বিনা’র বিজ্ঞানীদের শ্রম স্বার্থক হয়েছে। বর্তমান সরকার দেশের খাদ্য চাহিদা পুরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার জন্য দেশে আজ খাদ্যোভাব নেই। বিনাকে শক্তিশালী করতে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন বলেই পরমাণু শক্তিকে শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে বিনা কৃষি অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা সম্ভব হচ্ছে। এজন্য সরকারের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। এখন বড় প্রয়োজন স্বল্পকালীন উচ্চ ফলনশীল বিনার জাত ও প্রযুক্তিগুলো কৃষক হাতে পৌঁছে দেয়া অতি জরুরি।
তিনি আরো বলেন, বিনা’র আমন মৌসুমের বিনাধান-১১, ১৬, ১৭ ও বোরো মৌসুমের বিনাধান-৮ ও ১০ ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, আফি”কার সিয়েরা লিওনসহ বেশ কয়েকটি দেশে চাষাবাদ হচ্ছে। উল্লেখ্য, ভারতে বিনাধান-১০, বিনাধান-১১, বিনাধান-১২ ও বিনাধান-১৭ খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
বিনা’র ডিজি আরো বলেন, দেশে বিনা’র জাত আমন মৌসুমে সবচেয়ে বেশি আগাম ও উচ্চ ফলনশীল। আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি সময়ে মাঠে যেসব জমিতে পাকাধান দেখবেন প্রায় সবই বিনা উদ্ভাবিত ধানের জাত। এসময়ে বাস কিংবা ট্রেনে বসে ধানের মাঠের দিকে তাকালেই চোখে পড়বে সবুজ দিগন্ত ধানের মাঠে ভাসছে খন্ড খন্ড সোনালী রংয়ের পাকা ধানের ক্ষেত। মনে হয় যেন শিল্পীর আঁকা একটি চিত্র কর্ম। সুখবর হচ্ছে বিনা ধানের এই জাত ছড়িয়ে যাচেছ দেশ জুড়ে।