কন্যাশিশু ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। করোনাকালে ঘরবন্দি জীবনেও নিরাপদ ছিল না কন্যাশিশুরা। একের পর এক শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেই চলছে। শিশুদের চকলেট বা খাবারের লোভ, ভয় ও মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে এবং ঘরে একা পেয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে। শুধু ধর্ষণ নয়, ধর্ষণের পর হত্যারও শিকার হয়েছে অনেকে। অভিভাবকরা খুব বেশি যত্নশীল হলেও অধিকাংশ কন্যাশিশু ঘরে-বাইরে নিরাপদ নয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর- এই নয় মাসে ১ হাজার ৮৯ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৪০২ জন।
সংস্থাটির তথ্যমতে, এ বছর শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ১৮৫টি বাল্যবিয়ের ঘটনাসহ ৩৩৮ কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের ঘটনা আগেও ঘটেছে। তবে দিন দিন ধর্ষণচেষ্টা, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। করোনাকালে ঘরবন্দি জীবনেও নিরাপদ ছিল না কন্যাশিশুরা। এ সময়ে ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যার ধরনও ছিল ভয়াবহ।
২১শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকায় ৭ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সায়েদাবাদের ১৪ কে এম দাস লেন এলাকায় দুই সন্তানসহ ভাড়া থাকেন শিশুটির বাবা। তিনি একজন গাড়ি চালক। ছোট মেয়ের বয়স যখন ৬ মাস তখন মারা যান তার স্ত্রী। সেই থেকে বাবা কাজে থাকলে সন্তানদের দেখাশোনা করেন আত্মীয়রা। তাদের অভিযোগ ওইদিন সন্ধ্যায় নির্যাতনের শিকার শিশুটি বাসার সামনে অপর এক শিশুর সঙ্গে খেলছিল। তখন শিশুটিকে ডেকে নিয়ে পাশের ভবনের পঞ্চম তলায় ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ৩ জনকে আটকও করেছে ওয়ারী থানা পুলিশ। পুলিশ জানায়, নির্যাতনের শিকার শিশুটি তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে চিকিৎসা নিয়েছিলো।
এর আগে ১২ই সেপ্টেম্বরে রাজধানীর হজারীবাগে ৭ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। শিশুটির মা বলেন, ১০ই সেপ্টেম্বর তার মেয়েকে ফুসলিয়ে ফয়সাল নামে এক কিশোর বিকাল ৫টার দিকে ওই এলাকার একটি বাড়ির তিনতলায় ডেকে নিয়ে যায়। পরে তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। বাসায় ফিরে আসার পর মেয়ে অসুস্থ বোধ করলে তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে একথা জানায়। পরে থানায় মামলা করলে পুলিশ ফয়সালকে গ্রেপ্তার করে।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের তথ্য মতে, গত ৯ মাসে ৮১৩ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৮ জনকে। বিভিন্ন কারণে হত্যা করা হয়েছে ১৯৩ কন্যাশিশুকে। আর ১৫৬ কন্যাশিশু আত্মহত্যা করেছে। সংস্থাটির তথ্যমতে, গত বছরের তুলনায় এ সময় ১৩ ভাগ বেশি বাল্যবিয়ে সংঘটিত হয়েছে। ১৩৬টি ইউনিয়নে জরিপ পরিচালনা করেছে এ ফোরাম। এক হাজার ২৫৭ কন্যাশিশুর বাল্যবিয়ের কাগজপত্র সংগ্রহ করেছে সংস্থাটি। এ ছাড়া অলিখিতভাবে এক হাজার ৫৩৫টি বাল্যবিয়ে হওয়ার তথ্য পেয়েছে। সব মিলিয়ে ১৩৬ ইউনিয়নে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ২ হাজার ৭৯১ কন্যাশিশু।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি মানবজমিনকে বলেন, চলতি বছর কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন, ধর্ষণসহ বাল্যবিয়ের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এর অন্যতম কারণ, দেশে আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে দিন দিন এ ধরনের অপরাধ বেড়েই চলেছে। সরকারকে আগে বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও জানান, করোনাকালে সরকার স্বাস্থ্য খাতে বেশি জোর দেয়ায় কন্যাশিশুর নিরাপত্তার বিষয়ে নজর দিতে পারেনি। ফলে এ সময় এ ধরনের ঘটনা আরও বেড়েছে। কন্যাশিশুর প্রতি ধর্ষণ প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি উভয় উদ্যোগই সমানভাবে প্রয়োজন। একইসঙ্গে পুরুষদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ছোট ছেলেমেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের দিকে খেয়াল রাখাটাও জরুরি। বিশেষ করে শিক্ষকদের স্কুলের বাচ্চাদের এই বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে। তিনি জানান, অতীতেও দেখা গেছে, সাধারণত নানা রকম প্রভাবের কারণে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। দু’একটি ঘটনায় সামাজিক চাপে বিচার হয়। শিশুরা কোনো কিছু বলতে পারে না বা কোনোভাবেই বাধা দিতে পারে না। ফলে তারা সহজেই অপরাধের শিকার হচ্ছে। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা এমন সংগঠনের নেতারা জানান, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে দেশে ধর্ষণের ঘটনা কমছে না। দেশে আইন আছে, কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত না করা গেলে এই অপরাধ কোনোভাবে কমানো যাবে না।
এদিকে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ৬২৬ শিশু ধর্ষণের শিকার এবং বাল্যবিয়ে ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের শিশুদের সার্বিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক পর্যালোচনায় উঠে এসেছে। প্রকাশিত শিশু অধিকার বিষয়ক সংবাদ পর্যালোচনা অনুযায়ী এই সময়ে বছর জুড়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬২৬ জন শিশু এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৩৭ জন শিশুকে। অন্যদিকে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ১০১ শিশু। এমজেএফের পর্যালোচনা অনুযায়ী অবনতিশীল শিশু অধিকার পরিস্থিতি থেকে এটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয় যে বাংলাদেশের শিশুরা তাদের ঘরেই নিরাপদ নয়, কারণ অধিকাংশ শিশু-ধর্ষণ পারিবারিক পরিমণ্ডলে পরিচিতদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। একইভাবে পারিবারিক প্রভাবের কারণেই করোনাকালে বাল্যবিয়ে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, হত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে আরও ১৪৫ জন শিশু। এ সময় ১৩ থকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরাই ধর্ষণের শিকার হয়েছে বেশি। এরপর রয়েছে ৭ থেেক ১২ বছর বয়সী শিশুরা।
চলতি বছরের শুধু এপ্রিল মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১২১ জন। গত কয়েক মাসের মধ্যে এ মাসেই সবচেয়ে বেশি কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ মাসে ৮১ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৬৪ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার, ১৩ জন কন্যাশিশু দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার এবং ৪ জন ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে। এ ছাড়া ১৩ জন শিশুসহ ১৬ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। দুই জন কন্যাশিশুসহ ৪ জন শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে। পাঁচ জন শিশুসহ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ৮ জন। এসিড দগ্ধের শিকার হয়েছে ১ জন। ১৩ জন শিশু অপহরণের ঘটনা ঘটেছে বলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী জানা গেছে।