শৈশবে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশাপাশি বেঞ্চে বসে ক্লাস করেছেন দুই বন্ধু। একজন পড়াশোনা করে হয়েছেন দেশের নামকরা ডাক্তার তারপর মন্ত্রী। আর অপরজন পরিচ্ছন্নকর্মী হিসেবেই ভাগ্যের পরিহাসকে মেনে নিয়েছেন। তাই বলে মন্ত্রী বন্ধুটি সেই পরিচ্ছন্নতাকর্মী বন্ধুকে ভুলে যাননি। না, এটা ভিন্ন কোনো দেশের ঘটনা নয়, বাংলাদেশেরই ঘটনা।
সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান সম্প্রতি সরকারি সফরে রংপুর গিয়েছেন। সরকারি সফর হলেও রংপুর তার শৈশবের শত সহস্র স্মৃতির শহর। আর সেখানে গিয়েই দেখা হয় প্রতিমন্ত্রীর বাল্যবেলার বন্ধু ছিতুয়ার সঙ্গে। পুরো বিষয়টি প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান নিজেই ফেসবুকে লিখেছেন।
ডা. এনামুর রহমান লিখেছেন, পতাকাবাহী গাড়ি। পুলিশ প্রটোকল। বাড়তি লোকজনের ভিড়। এসব দেখে কিছুটা হতভম্ব ছিতুয়া। আমাদের সেই বন্ধুত্বের আবেগ আর আমার দূরন্তপনার দিনগুলো তখন অতীতের স্মৃতির ঝাঁপি খুলে জ্বলজ্বলে তারা হয়ে উপস্থিত আমার চোখের সামনে। কিন্তু ছিতুয়া প্রচণ্ড আড়ষ্ট। নিজেকে আড়াল করার কি ব্যর্থ চেষ্টা! আমি বুঝতে পারছিলাম, প্রতিমন্ত্রী হিসেবে চারপাশের প্রটোকলের আবহ ছিতুয়া আর আমার সম্পর্কের মধ্যে এক অদৃশ্য দেয়াল টেনে দিচ্ছে।
প্রতিমন্ত্রী লিখেছেন, জনারণ্যে ‘এ্যাই ছিতুয়া’ বলে ডাকতেই ফিরে তাকালো সে। পড়ন্ত বয়সেও যেন সেই হারানো যৌবনের চকচকে চোখে মৃদু হাসিতে তাকালো আমার দিকে। দৃষ্টি বিনিময় হতেই বন্ধুকে বুকে টেনে নিয়ে বুক ফুলিয়ে গর্বের সাথে বললাম, এই ছিতুয়াই আমার স্কুলের বন্ধু। ছিতুয়ার তখন ছল ছলে চোখ। আমারও গোপন অশ্রুবিন্দু গুলো তখন স্মৃতির মণিমুক্তা হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে দুই নয়ন।
বন্ধুর বর্তমান অবস্থান জানিয়ে লিখেছেন, রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচ্ছন্নতাকর্মী (সুইপার) থেকে সম্প্রতি অবসর নিয়েছে ছিতুয়া। ছিতুয়ার পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে ধারাবাহিক পেশাগত সম্পর্ক ধরে রেখেছে বৌদি গীতা রানী। সেও এখন সুইপার পদে কর্মরত। তো আসছি ছিতুয়ার প্রসঙ্গে। আমার বাবা মরহুম আক্তারুজ্জামান খান ছিলেন এই অফিসেরই উচ্চ মান সরকারি ( ইউডি এ্যাসিস্টেন্ট)। আর ছিতুয়ার মা (আমাদের প্রিয় মাসি মা) চানিয়া রানী ছিলেন সুইপার।
স্মৃতিচারণ করে প্রতিমন্ত্রী লইখেছেন, তখন ছিলো স্বর্ণালীযুগ। আমরা যে মূল্যবোধে বেড়ে উঠছিলাম, সেখানে জাতপাতের কোন বালাই ছিল না। আরো অন্যান্য বন্ধুদের মতো ছিতুয়া-ও ছিলো আমার দুরন্ত শৈশব আর কৈশোর অসাধারণ এক বন্ধু। রংপুরের রবার্টসনগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই ছিলো ছিতুয়া। তারপর পড়াশোনায় সে ইস্তফা দিলেও আমাদের বন্ধুত্বে ভাটা পড়েনি কখনো। আহারে জীবন। আমার সোনালী অতীত। সোনালী কৈশোরের কত শত স্মৃতি মাখা এই রংপুর। আজ ছিতুয়া ঝাপসা করে দিচ্ছে আমার চোখদুটো।
শৈশবের দুরন্তপনার কথা উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী এনাম বলেন, ছিতুয়া আর আমার দূরন্তপনায় রীতিমতো অস্থির থাকতো পানি উন্নয়ন বোর্ডের কলোনি। আমি দুঃসাহসী গেছো ছিলাম। যে কোন গাছে কাঠবিড়ালের মতো তরতর উঠে পড়তে আমার আর ছিতুয়ার ছিলো জুড়ি মেলা ভার। তো কলোনির আঙিনায় সারি সারি নারিকেল গাছের নারকেল পরিপক্ক হবার আগেই তা আমাদের কারণে সাবাড় হয়ে যেতো। তেমনি আম কাঁঠালও। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে কৈশোরের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো একদিকে যেমন আনন্দের অন্যদিকে অনেক কষ্টের। সেই আনন্দ আর কষ্টের মিশেলে ভিন্ন এক অনুভূতি আজ উপহার হিসেবে তুলে দিয়েছে আমার বন্ধু ছিতুয়া।
বন্ধুত্বের সম্পর্কের স্থান কোথায় হবে, সে প্রসঙ্গের অবতারণা করে লিখেছেন, সরকারি চাকরি কনটিনিউ করলে বেশ কয়েক বছর আগে আমার নিজেরো অবসর নিতে হতো। আমার বন্ধুদের অনেকেই দেশবরেণ্য চিকিৎসক, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট জেনারেল, অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিবসহ আরো কত কি! ছিতুয়া অবশ্যই তাদের তুলনায় কম কিছু নয়। বন্ধু মানে আস্থা, নির্ভরতা। বন্ধু মানে ভালোবাসা, যেখানে থাকে না কোনো স্বার্থ। গাড়ির পতাকা, প্রটোকল, পদ-পদবী, সামাজিক অবস্থান এগুলো সব কিছুই সাময়িক। কিন্তু বন্ধুত্বের বন্ধন চিরদিনের। ছিতুয়া বন্ধু আমার। তোর জন্য ভালোবাসা।