কুমিল্লার ঘটনায় দেশব্যাপী নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। দেশের ৩৫ জেলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়েছে। মেট্রোপলিটন এলাকার মধ্যে রাজধানী ঢাকা ও সিলেট নগরীতে বিজিবি সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়াও র্যাব ও পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। গতকাল সকাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেন। জুমার পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন মুসল্লিরা। এ সময় বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় মুসল্লিদের। গতকাল জুমার পর রাজধানীর নয়াপল্টন-কাকরাইলের নাইটেঙ্গেল মোড়ে পুলিশের সঙ্গে মুসল্লিদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে।
এ সময় পুরানা পল্টন থেকে নাইটেঙ্গেল মোড় পর্যন্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। তার আগে জুমার নামাজ শেষে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিল থেকে পবিত্র কোরআন অবমাননার প্রতিবাদের নানা স্লোগান দেন মুসল্লিরা। শুরুতেই মিছিলটি পুলিশের বাধার মুখে পড়ে। বাধা পেরিয়ে মিছিলকারীরা নাইটেঙ্গেল মোড়ের দিকে এগিয়ে যায়। সেখান থেকে কাকরাইলের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ করলে বিক্ষুব্ধ মিছিলকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এ সময় টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পুলিশ। দফায় দফায় সংঘর্ষ চলতে থাকে। একপর্যায়ে আশপাশের গলিতে অবস্থান নেয় বিক্ষোভকারীরা। থেমে থেমে সংঘর্ষের প্রায় এক ঘণ্টা পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয় পুলিশ।
তার আগে বেলা ১১টা থেকে পল্টন মোড়ে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে প্রবেশমুখে বিজিবি সদস্যরা অবস্থান নেন। দক্ষিণ গেটে টহলে ও নিরাপত্তায় সতর্ক অবস্থায় ছিল র্যাব সদস্যরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার মো. আবদুল আহাদ জানান, সকাল থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে ছিল। নামাজ শেষে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। মিছিলকারীরা নাইটেঙ্গেল মোড় পর্যন্ত যখন যায় খুবই বিক্ষুব্ধ অবস্থায় ছিল। পুলিশ তখন তাদের শান্ত হওয়ার জন্য বলে এবং সেখান থেকে ঘুরিয়ে দেয়। তখন তারা বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল মারতে শুরু করে। তখন বাধ্য হয়ে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। লাঠিচার্জ করার পর তখন তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং আশপাশে থাকা গলিতে অবস্থান নেয়।
উপ-কমিশনার মো. আবদুল আহাদ আরও জানান, বিকাল পর্যন্ত তারা বিক্ষুব্ধ অবস্থায় ঘোরাফেরা করে। বিকাল তিনটার সময় তারা বায়তুল মোকাররম থেকে আরেকটি মিছিল নিয়ে পল্টন মোড় পর্যন্ত এসে ঘুরে যায়। ঘুরে যাওয়ার সময় তারা বায়তুল মোকাররমের ওভার ব্রিজের নিচে রাস্তায় কাঠে আগুন জ্বালিয়ে সরে যায়। পুলিশ এসে আগুন নিভিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। পুলিশের রমনা জোনের সহকারী কমিশনার বায়জিদুর রহমান জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় তিনিসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
স্টাফ রিপোর্টার, নবীগঞ্জ থেকে জানান: নবীগঞ্জের করগাঁও ইউনিয়নে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৭টায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় নবীগঞ্জ থানার ওসিসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় দু’জনকে সিলেটে পাঠানো হয়েছে। আহতরা হলেন, নবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ডালিম আহমেদ (৪২), নিরাপদ দাশ (৩৮), বদরুল হোসেন (১৬), সাজনা বেগম (৩০), সতীশ দাশ (৬২), অপু দাশ (৩৫), প্রিয়াংকা দাশ (২২), কুটন দাশ (৩৫), সুপ্রদীপ দাশ (২৫), সৈতেন্দ দাশ (৬৫), ইব্রাহিম মিয়া (৩০), বনজিত দাশ (৫৫)। গুরুতর আহত অবস্থায় পুরভী দাশ (৫২), বিউটি দাশ (২০)-কে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, উপজেলার করগাঁও ইউনিয়নের গুমগুমিয়া গ্রামের পাঞ্জারাই জি.কে.ওয়াই দাখিল মাদ্রাসার ছাত্ররা স্থানীয় যুবকদের নিয়ে মিছিল বের করে। মিছিলটি গুমগুমিয়া গ্রামের দুর্গা মন্দিরের সামনে পৌঁছালে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।
খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে ওসি মো. ডালিম আহমদ মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন। আহতাবস্থায় তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনার পর সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ মিলাদ, সিলেটের ডিআইজি মো. মফিজ উদ্দিন, হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার এস এম মুরাদ আলী, হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আলমগীর চৌধুরী, নবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ ফজলুল হক চৌধুরী সেলিম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মহিউদ্দিন, সার্কেল এএসপি আবুল খায়ের ঘটনাস্থলে পৌঁছে উভয়পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। ওই এলাকায় র?্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম মোতায়েন করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মহিউদ্দিন বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রতিমা বিসর্জন সম্পন্ন হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, কুমিল্লা থেকে জানান, কুমিল্লায় সড়কগুলোতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে র্যাব-বিজিবি-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল ও কড়া নজরদারি লক্ষ্য করা গেছে। এদিকে পূজামণ্ডপকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ঘটনায় গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত জেলার ৩টি থানায় ৬টি মামলায় ৬৮৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় ৪টি মামলায় ৬১ জনকে এজাহারনামীয় ৫শ’ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। এছাড়া সদর দক্ষিণ মডেল থানায় একটি মামলায় ৮০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। দাউদকান্দি থানার একটি মামলায় ৪০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। এদিকে র্যাব জানায়, পূজামণ্ডপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের মৃত তাজুল ইসলামের ছেলে গোলাম মাওলাকে (২৬) গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে গতকাল দুপুরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল কুমিল্লা নগরীর নানুয়া দীঘিরপাড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পূজামণ্ডপ পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কুমিল্লায় পূজামণ্ডপের ঘটনার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা সরকারের জন্য চরম ব্যর্থতা। এ ব্যর্থতার জন্য সরকারকে ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করা উচিত। এ সময় সরকারকে পদত্যাগ করে জাতীয় সরকার গঠন করে মানুষের জীবন-জীবিকা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দু পরিবারে বাড়িঘরে হামলা ও মন্দির ভাঙচুর ঘটনার একটিরও বিচার হয়নি। নাসিরনগরে হিন্দু পরিবারে যারা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করেছিল তারাই নৌকার মনোনয়ন পেয়েছে। কুমিল্লার ঘটনার জন্য পুলিশের গাফিলতি ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদের মহাসচিব শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, মুক্তিযোদ্ধা নঈম জাহাঙ্গীর, গণস্বাস্থ্যের কেন্দ্রের প্রেস উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু, ভাসানী অনুসারী পরিষদের নেতা শহীদ আসাদের ভাই ডা. নুরুজ্জামান, আল মুকিত, সাইফুল ইসলাম শুভ, গণসংহতি আন্দোলন-কুমিল্লার আহ্বায়ক ইমরান জুলকারনাইন ইমন প্রমুখ।
এ ঘটনার সঙ্গে বাইরের দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত বলে মন্তব্য করে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সরকারের সকল ব্যর্থতা অন্য দিকে প্রবাহ করতে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ৯৯৯-এ কে ফোন দিয়েছিল তাও খুঁজে বের করা উচিত। এতো পুলিশের মাঝে কেন এমন ঘটনা ঘটলো। পুলিশ তখন কি করেছে? এখন লোক দেখানো ধরপাকড় চালানো হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য খুতবায় বয়ান করার জন্য তিনি আলেমদের প্রতি আহ্বান জানান। মণ্ডপের ন্যক্কারজনক ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে দ্রুত বিচারের দাবি জানান তিনি।
এছাড়া একই সময়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক নীলচন্দ্র ভৌমিকের নেতৃত্বে পৃথক প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং এ ঘটনার নিন্দা জানায়। প্রতিনিধিদলে ছিলেন পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য এডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, যুগ্ম সম্পাদক মনিন্দ্র কুমার নাথ, এডভোকেট শ্যামল রায়, কেন্দ্রীয় নেতা চন্দন ভৌমিক, জেলা শাখার সভাপতি চন্দন রায়, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট তাপস বকশি, জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের নেতা নির্মল পাল।
চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, হাজীগঞ্জ উপজেলায় গত ১৩ই অক্টোবর রাতে পুলিশ-জনতা সংঘর্ষের ঘটনায় তিনটি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় দুই হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। হাজীগঞ্জ থানায় হামলা ও পুলিশের আহতের ঘটনায় পুলিশ দু’টি মামলা করে। এছাড়া রাজারগাঁও ইউনিয়নের মুকন্দসার গ্রামে হামলার ঘটনায় একটি মামলা করা হয়েছে। গতকাল দুপরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাজীগঞ্জ-ফরিদগঞ্জ সার্কেল) মো. সোহেল মাহমুদ এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, হাজীগঞ্জ উপজেলায় মোট ১২টি পূজামণ্ডপ ভাঙচুর হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে দু’টি ও মন্দির ভাঙার দায়ে মন্দির কর্তৃপক্ষ একটি মামলা করেছে। এ পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে জনতা-পুলিশের সংঘর্ষে নিহতের ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ৭ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। হাজীগঞ্জ থানার ওসি হারুনুর রশিদ জানান, বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আসামিদের শনাক্ত করা হচ্ছে। এদিকে বুধবার রাতে হাজীগঞ্জ বাজারে সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত আল আমিন, শামীম ও হৃদয়ের দাফন হাজীগঞ্জের নিজ নিজ গ্রামে সম্পন্ন হয়েছে। নির্মাণ শ্রমিক বাবলুর লাশ গ্রামের বাড়ি চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার সুন্দরগঞ্জ ভাগডাঙ্গায় নেয়া হয়েছে।