প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য সরকারের বরাদ্দ দেয়া হাজার টাকার উপবৃত্তিতে কোটি টাকার জালিয়াতি ধরা পড়েছে। আর এই জালিয়াত চক্র এতটাই ধুরন্ধর যে, সরকারের তহবিল থেকে বরাদ্দ দেয়ার পর শিক্ষার্থীদের বাবা অথবা মায়ের মোবাইলে টাকা পৌঁছানোর আগেই কোনো পিন বা ওটিপি নম্বর ছাড়াই কিস্তির সমুদয় টাকা তুলে নিচ্ছে। উপবৃত্তির টাকা বিতরণে সহায়তাকারী সংস্থা সরকারের ডাক বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘নগদ’ কর্তৃপক্ষ কিছুই করতে পারছে না। নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানে দেশের বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ের কয়েক শ’ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা জালিয়াত চক্র হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ধরা পড়েছে।
গত তিন মাসে নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানে দেখা গেছে ‘নগদ’ এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে খুদে শিক্ষার্থীদের বাবা কিংবা মায়ের মোবাইল থেকে উপবৃত্তির প্রায় ৫০ কোটি টাকা উধাও হয়েছে। সরকার যদি সুষ্ঠুভাবে আরো সময় নিয়ে উপবৃত্তির এই অর্থ জালিয়াতির ঘটনা অনুসন্ধান করে তাহলে হয়তো আরো বেশি অর্থ আত্মসাতের ঘটনা উদঘাটিত হবে এবং জড়িতদের খুঁজে বের করে আনা সম্ভব হবে। কেননা যেহেতু মোবাইল অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এই অর্থ লোপাট হচ্ছে তাই সুষ্ঠুভাবে এবং আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে অনুসন্ধান চালালে দুষ্কৃতকারীদের ধরা সম্ভব হবে।
অনুসন্ধানে সহায়তাকারী একটি সূত্র জানায়, মাত্র তিন মাসে প্রাথমিকের উপবৃত্তির টাকা লোপাটের যে চিত্র ধরা পড়েছে তাতে সারা দেশে কী পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে সেটা সহজেই অনুমেয়। সূত্র আরো জানায়, মাত্র কয়েকটি উপজেলায় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে শিশু-শিক্ষার্থীদের অর্থ লোপাটের যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে তাতে যে কেউই আঁতকে উঠবেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০২০ সালের এপ্রিল মে ও জুন এই তিন মাসের উপবৃত্তির টাকা ছাড় হওয়ার পর সারা দেশে বহু সুবিধাভোগী মায়ের মোবাইল ফোনকলের মাধ্যমে ওটিপি পিন কোডে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সঙ্ঘবদ্ধ এই চক্র। সূত্র মতে, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর ছয় মাসের উপবৃত্তির টাকা একসাথে এবং পরবর্তীতে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত আরো ছয় মাসের টাকা ছাড় হওয়ার পর থেকে কোনো পিন কোড বা ওটিপি নম্বর ছাড়াই মোবাইল থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বিশাল অঙ্কের টাকা। সাধারণ একটি হিসাবেই টাকার পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে আরো দেখা গেছে, যে প্রক্রিয়ায় উপবৃত্তির টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে সেখানে উন্নত প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হয়েছে। কেননা অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্য কিছু কিছু উপজেলায় এমন কিছু ‘নগদ’ এজেন্ট নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে যেসব এজেন্ট নম্বরের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের অর্থ জালিয়াতিতে ব্যবহৃত বেশ কিছু এজেন্ট নম্বর স্থায়ীভাবে বন্ধ রয়েছে। আবার বেশ কিছু নম্বরের বিষয়ে খোদ ‘নগদ’ কর্র্র্তৃপক্ষও কোনো তথ্য দিতে পারছে না। এ দিকে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে প্রতারণার শিকার বেশ কিছু মা তাদের সন্তানের উপবৃত্তির অর্থ খুইয়ে এখন উপজেলা শিক্ষা অফিসে গিয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করছেন। উপবৃত্তির ৯০০ টাকা খুইয়ে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা শিক্ষা অফিসে লিখিত অভিযোগ করেছেন রোজিনা নামের এক মা। অভিযোগে তিনি লিখেছেন, তার ছেলে ইকরাম স্থানীয় দাউদকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। উপবৃত্তির অর্থ পেতে তিনি তার নিজের মোবাইল নাম্বার (০১৮৮০৩—-৯২) স্কুলে দিয়েছেন। কিন্তু তার টাকা উঠানোর আগেই সব টাকা লোপাট হয়েছে। যার ট্রানজেকশন আইডি নম্বর (৭০ঝতঅঙগছ)
অন্য দিকে দুই সন্তানের উপবৃত্তির ৩৬০০ টাকা খুইয়ে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলা শিক্ষা অফিসে লিখিত অভিযোগ করেছেন বাবা নজরুল ইসলাম। স্থানীয় খিলদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে ছেলে সাহেদ ও মেয়ে নূরী। পাশের বাজারের নগদ এজেন্ট দোকান থেকে তার দুই সন্তানের উপবৃত্তির সব টাকাই পিন ও ওটিপি নম্বর ছাড়াই তুলে নিয়েছে একটি চক্র। এজেন্টের নাম নন্দী মেডিক্যাল হল, এজেন্ট মোবাইল নং ০১৯০৬—২৭৭। ট্রানজেকশন আইডি নং (৭০টককঝঋক)।
এমন আরো অভিযোগ করেছেন কুমিল্লার দাউদকান্দির দৌলতেরকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুরাদনগরের অভিভাবক সুমন ভুইয়া, হোমনার এক মা উম্মেহানি, কালিহাতীর পারভিন, মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের উত্তর কুমারভোগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হিরণ মাতবর আরেক অভিভাবক আসমা আকতারসহ অনেক অভিভাবক। তাদের অনেকে আবার এজেন্ট কর্র্তৃক অতিরিক্ত চার্জ কর্তনের বিরুদ্ধেও উপজেলা শিক্ষা অফিসে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
আবার ১১ ডিজিটের মোবাইল নম্বরে নগদের এজেন্ট খুলে উপবৃত্তির টাকা হাতিয়ে নেয়ারও প্রমাণ মিলেছে। সেখানে দেখা গেছে একই নম্বরের মোবাইল ব্যবহার করে শুধু শেষের একটি বা দু’টি ডিজিট পরিবর্তন করেই একাধিক এজেন্ট নম্বর খুলে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। এমন একটি প্রতারক চক্রের তালিকাও নয়া দিগন্তের প্রতিবেদকের কাছে এসেছে। সেখানে দেখা গেছে অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিয়ে প্রতারণা করেছে একটি চক্রেরই ৩৩টি এজেন্ট নম্বর থেকে।
এই চক্রটি অত্যন্ত সুচারুভাবে ৪৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎ করেছে। এই ৩৩টি এজেন্ট কোন কোন ট্রানজেকশন নম্বরে টাকা পাঠিয়ে তুলে নিয়েছে সেটিও অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে ৩৩টি এজেন্টের মধ্যে ২৮টি এজেন্ট পৃথক পৃথক ট্রানজেকশন নম্বরে ৩০ হাজার ১৫৬ টাকা তুলে নিয়েছে। আবার অভিভাবকদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে জানা যায়, কিছু এজেন্ট অতিরিক্ত চার্জ কর্তনের নামেও বেশ কিছু টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। টাকার পরিমাণ ১৮ হাজার ৫ টাকা।
শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা আত্মসাতের ঘটনায় সারা দেশে যখন তোলপাড় চলছে ঠিক তখনি বিষয়টি সরেজমিন অনুসন্ধান শুরু করেছে শিক্ষা বার্তা কমিউনিকেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংগঠনটির প্রধান কাজী আবু সাঈদ এই প্রতিবেদককে জানান, প্রাথমিক স্তরে উপবৃত্তি প্রদানে যেসব অসঙ্গতি রয়েছে আমরা সেগুলো সরকারের নজরে এনে প্রকারান্তরে সরকারকেই সহযোগিতা করতে চাই। আমরা চাই দরিদ্র অভিভাবকদের হাতেই উপবৃত্তির টাকা পৌঁছে যাক। আর এই কাজে যেসব ত্রুটি রয়েছে সেগুলো সুচারুভাবে সরকার কাটিয়ে উঠুক। প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো আরো সফল ও সার্থক হোক। আমরা মূলত সরকারকে সহযোগিতা করতেই স্বেচ্ছাশ্রমে এই কাজটি শুরু করেছি।
এদিকে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ি উপজেলা শিক্ষা অফিসার আনজুম আরা গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে জানান, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা আত্মসাতের বিষয়ে আমরা বেশ কিছু লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তবে এটার বিষয়ে শক্ত কোনো অ্যাকশনে যেতে হলে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সার্বিক তত্ত্বাবধান লাগবে। আমরা প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট থানারও সহযোগিতা নেয়ার চিন্তা করছি। প্রতারণার সাথে জড়িত এজেন্টগুলোকে চিহ্নিত করতে প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন প্রশাসনেরও সহযোগতিা নেয়া হতে পারে। আমরা সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি।
শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা লোপাটের বিষয়ে ‘নগদের’ হেড অব পাবলিক কমিউনিকেশন মো: জাহিদুল ইসলাম জানান, বেশ কিছু জায়গায় অভিভাবকদের টাকা গচ্ছা গেছে এমন অভিযোগ আমরাও পেয়েছি। তদন্ত করে দেখেছি কিছু জায়গায় স্কুলের সাথে সম্পৃক্ত একটি চক্র কৌশলে অভিভাবকদের ‘নগদ’ অ্যাকাউন্টের পিন কোড নিয়ে তারাই টাকা তুলে নিচ্ছে। আর এমন বেশ কিছু অভিযোগের সত্যতা পেয়ে নরসিংদীর রায়পুরা এবং রংপুর অঞ্চলের কয়েকটি এলাকায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। পুলিশ সেখানে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করেছে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে স্কুলের সাথে জড়িত কিছু ব্যক্তি কৌশলে অভিভাবকদের পিনকোড নিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছে। আর এমন অভিযোগ পেলে ‘নগদ’ কর্তৃপক্ষ সব সময়ই শক্ত হাতে দুষ্কৃতকারীদের দমন করবে। তবে হ্যাঁ, একটি কথা এখানে প্রত্যেক অভিভাবককেই মনে রাখতে হবে, সেটা হলো পিন কোড ছাড়া ‘নগদ’ থেকে একটি টাকাও তোলা যাবে না। তাই কোনো অবস্থাতেই পিন কোড কাউকে শেয়ার করা যাবে না। এমনটি হলে নগদ কর্তৃপক্ষ কোনো কিছুই করতে পারবে না।