হাসপাতালের বেডেও আতঙ্ক

Slider বিচিত্র

64149_f1

৩৫ বছর বয়সী নাজমুল হুসাইন। এক যুগ ধরে বাস করছেন ঢাকায়। ১০ হাজার টাকা বেতনের ছোট্ট চাকরি। স্ত্রী আর দু’সন্তান নিয়ে টেনেটুনে চলছিল তার জীবন। কিন্তু গত ৩রা জানুয়ারি হঠাৎ করেই বদলে যায় সবকিছু। তার দাবি, ওইদিন বাজার করতে যাওয়ার পথে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার পায়ে গুলি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এরপর তার ঠাঁই হয়েছে পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত জাতীয় অর্থপেডিক ও পক্ষাঘাত পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে

নাজমুল হুসাইন একা নন। গুলিবিদ্ধ এমন বেশ কয়েকজনই ভর্তি আছেন সেখানে। যন্ত্রণায় কাতর তাদের মুখ। কারও কারও পাহারায় পুলিশ। বেশির ভাগের চোখে-মুখেই আতঙ্ক। নাম-পরিচয় দিয়ে কোন কথাই বলতে রাজি নন। তাদের আশঙ্কা- কথা বললেই কোনরকমে বেঁচে যাওয়া জীবনটাও হারাতে হতে পারে।

পঙ্গু হাসপাতালে কথা হয় পুলিশ পাহারায় চিকিৎসাধীন নাজমুল হুসাইনের সঙ্গে। তিনি জানান, মোহাম্মদপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। তাদের বড় মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। ছোট মেয়ের বয়স দুই বছর। বর্তমানে তিনি চাকরি করেন চাঁদ উদ্যান এলাকার একটি মাল্টিপারপাস সমিতিতে। এর আগে বেশ কয়েকটি গার্মেন্টসেও চাকরি করেছেন তিনি। নাজমুল জানান, গত ৩রা জানুয়ারি সকাল ৯টার দিকে তিনি বাজার করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু রাজিয়া সুলতানা রোডে পৌঁছানোর পর কয়েকজন পুলিশ তাকে ডাক দেয়। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে সেখানে যাওয়ার পর পুলিশ সন্ত্রাসীদের মতো খপ করে তাকে ধরে ফেলে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এবং কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই তার ডান পায়ে গুলি করে এক পুলিশ সদস্য। পরে ওই পুলিশ সদস্যরাই তাকে এই হাসপাতালে এনে ভর্তি করেন। তিনি বলেন, পুলিশ কেন আমাকে গুলি করলো তা আমি জানি না। এর আগে কখনো এইসব পুলিশের সঙ্গে দেখাও হয়নি। তার কোন শত্রুও নেই। নাজমুল বলেন, শুনেছি আমার নামে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হয়েছে। তবে কিসের মামলা তাও তিনি বলতে পারেন নি। তার স্ত্রী জানান, গত ১৩ তিন ধরে প্রতিদিনই তাকে তিনটি করে ইনজেকশন দিতে হচ্ছে। যার প্রত্যেকটির দাম ৮০০ টাকা। এছাড়া, প্রতিদিনই বেড ভাড়া দিতে হয় ২৭৫ টাকা। সম্পূর্ণ ঋণ করে বর্তমান এই চিকিৎসা ব্যয় চালাতে হচ্ছে বলেও জানান নাজমুল। নাজমুলের সামনেই ছিল পুলিশের গুলিতে আহত আরও তিনজন। তারাও পুলিশ পাহারায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তবে তারা কোন কথাই বলতে চাননি। আহতদের নিরপরাধ দাবি করে তাদের স্বজনরা জানান, কথা বললে আরও সমস্যা হবে। এ সময় টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার বাসিন্দা গুলিবিদ্ধ অহিদুল ইসলাম কেঁদে ওঠেন। মানুষ সত্যটা জানুক- এমন কথা বললেও এর বেশি বলতে চাননি আহত একজনের স্বজন। ওই স্বজন আরও জানান, সত্য বললে তাদের আরও বেশি সমস্যা হবে। সেখানে গুলিবিদ্ধ চিকিৎসাধীন অপর দু’জনও পরস্পর আত্মীয়। হাসপাতালের পাশাপাশি আরেকটি ওয়ার্ডে পুলিশ পাহারায় চিকিৎসাধীন আছেন বাগেরহাটের নয়ন। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি এবং তার স্বজনরা কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন সাংবাদিকরা আমাকে বাঁচাতে পারবে না। হাসপাতালের প্রিজন সেলে পুলিশি প্রহরায় চিকিৎসাধীন ছিলেন আরও তিনজন গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি। তবে তারাও কথা বলতে চাননি। সেখানে লক্ষ্মীপুর থেকে আসা পায়ে গুলিবিদ্ধ এক যুবক বলেন, গুলি করার পর আমার বিরুদ্ধে একটি মামলা দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু সাংবাদিকরা লেখার পর আরও চারটি মামলা হয়েছে। প্রায় মাসাধিককাল সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন কথা বলতে চাইলে জেলে আসেন। তিনি বলেন, আমার একটা পা চলে গেছে। আপনারা কি চান আমার বাকি পা-টাও চলে যাক? আমি গুলি খাওয়ার পর অনেক সাংবাদিক এসেছেন। অনেক লিখেছেন। আমি তখন অনেক খুশি হয়েছি। তখনতো বুঝিনি আমার কি সর্বনাশ করেছেন। পেশা কি জানতে চাইলে ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, আমি একজন সন্ত্রাসী। পারলে এটা লিখে দেন। আমার উপকার হবে। এ সময় বারবার জিজ্ঞেস করার পরও তিনি তার নাম-ঠিকানা বলেননি। বলেন, এখানে পুলিশ আছে। তাদের কাছেই জানেন আমি কি। ছোট্ট একটি প্রিজন সেলে কর্তব্যরত পুলিশের সংখ্যা ছিল ৯ জন। জরুরি বিভাগের তথ্যমতে গত একমাসে এখানে গুলিতে ও বোমায় আহত হয়ে ভর্তি হন ২৬ জন। এরা হলেন- ঢাকার আজিমপুরের তানজিলা আক্তার, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকার ফারুক, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের জাহাঙ্গীর, ঢাকার কলাবাগান এলাকার হাবিব উল্লাহ, কুমিল্লার মো. এনায়েত, দক্ষিণখান আজমপুরের ফয়েজ আলী সরকার, নোয়াখালী সেনবাগের এরশাদ উল্লা লেভিন, কুমিল্লা মেঘনা থানার মাসুম, হোমনা থানার স্বপন, শরীয়তপুরের  মনির হোসেন, মানিকগঞ্জের খোরশেদ, ময়মনসিংহের নাফি আহম্মেদ, মেহেদী, চাঁদপুরের আব্দুল বারেক, গোপালগঞ্জের রুবেল, বাগেরহাটের মোফাজ্জেল, মিরপুরের অনিক মল্লিক, রাজু, গাজীপুরের ফুলমামা, নাদির, রোমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আনিসুর রহমান, মোহাম্মদপুরের রাসেল, সোহরাব, বাগেরহাটের নয়ন, চুয়াডাঙ্গার মতিয়ার। এদের বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *