রাজনৈতিক ধৃষ্টাচারের পরিসীমা কতদূর!

Slider টপ নিউজ

গাজীপুর: এখনো আছে কিনা, জানা নেই। বেশ কয়েক বছর আগে টেলিভিশনে বউরাণী প্রিন্ট শাড়ির বিজ্ঞাপনে এই কথাগুলো বলা হয়েছে। একজন মানুষের পিঠে বউরাণী প্রিন্ট শাড়ি লিখে দেওয়া হয়। বিজ্ঞাপন চিত্রে পিঠে সাইনবোর্ড নিয়ে মডেল ঘরের বাইরে গেলে মানুষ কানাঘোষা করে । এক সময় মডেল বলে উঠেন, ঘরের কথা পরে জানল কেমনে। এরপর পিঠ ঘুরিয়ে সাইনবোর্ড দেখিয়ে বলা হয় এমনে।

বিজ্ঞাপনের সারমর্মটা এমন ছিল যে, ঘরে স্ত্রীর পরণে বউরাণী প্রিন্ট শাড়ি। স্ত্রী, এই কোম্পানীর শাড়ি অন্যান্য মেয়েরাও যেন পরে সেই জন্যে গোপনে স্বামীর পিঠে লিখে দেয় বউরাণী প্রিন্ট শাড়ি। পিঠে শাড়ির নাম লিখার পর স্বামী বাইরে গেলে অসংখ্য মানুষ জেনে ফেলে বউরাণী প্রিন্ট শাড়ির নাম। সম্ভবত এই বিজ্ঞাপনের মডেল ছিলেন মরহুম কৌতুক অভিনেতা ও কমেডিয়ান হিরু দিলদার।

বাংলাদেশ । সাংবিধানিকভাবে একটি উদারপন্থী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বিশ্বের সকল যুদ্ধের ইতিহাস ভঙ্গ করে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত ও দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত লাল সবুজের এই বাংলাদেশ। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ আমাদের মাতৃভূমি, আমাদের বাংলাদেশ। আমরা গর্ব করি, আমরা বাংলাদেশী নাগরিক। ২৪ বছরের নিরস্ত্র সংগ্রাম ও নয় মাসের স্বশস্ত্র যুদ্ধের ফসল একটি লাল সবুজের পতাকা।

পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় আইনী বা বে-আইনীভাবে আসা সরকার দেশ শাসন করেছে। সেবা করতে বলা সরকার শাসন করছে বিভিন্ন আবরণে । সৈরাচারী সরকার, সামরিক সরকার, একনায়কতান্ত্রিক সরকার, রাজপথের অস্থায়ী সরকার, তত্তাবধায়ক সরকার, সেনা সমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকার এই সবই বাংলাদেশ সরকারের আবরণ। যে পোষাকের সরকারই হোক না কেন, কাগজে কলমে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিলনা। শুধুমাত্র সংবিধান স্থগিত রাখা সরকারগুলো গণতন্ত্র নিষিদ্ধ করলেও বিচ্ছিন্নভাবে গণতন্ত্র চলমান ছিল। ফলে রাজনৈতিক প্রাচীরেই কম বেশি আবদ্ধ ছিল আমাদের বাংলাদেশ। তাই আমরা অধিকহারে রাজনৈতিক চর্চা করতে অভ্যস্থ।

এমন সময় ছিল, রাজনৈতিক নেতা গ্রেফতার হলে তোলপাড় পরে যেত। প্রশাসন সম্মানের সাথে গ্রেফতারকৃত নেতার বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। কিন্তু আমরা অধিকহারে রাজনৈতিক চর্চা করতে গিয়ে কখন যে গণতন্ত্র বিমুখ হয়ে গেছি, তা আমাদের মনে নেই। রাজনীতি বলতে ক্ষমতা অর্থ ও প্রতিপত্তিকে বুঝে নেওয়ার কারণে গণতন্ত্র অসহায় হয়ে গেছে। দেশপ্রেমে বলিয়ান হয়ে দেশ ও জনগণের সেবা করা অনেকটা বিলুপ্তির পথেই বলা যেতে পারে। তাই রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ঘুণে ধরে গেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাজনীতি ও আমাদের রাজনীতি বিপরীত মুখি অবস্থানে চলে যেতে চাইছে।

এমতবস্থায় আমাদের দেশে ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ চিন্তিত। রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় গিয়ে যা যা করেন ক্ষমতা হারিয়ে অনুশোচনা করেন। বিবেকের দায়বদ্ধ উদাসীনতা আমাদের নিশ্চয়তায় বিগ্ন ঘটাতে চায়। তবু শ্রদ্ধা ও সম্মানের জায়গা রাজনীতিই। আমরা দেশ পরিচলনায় রাজনীতিবিদদের উপর স্বসম্মানে আস্থা রাখতে চাই। কিন্তু রাজনীতির ঘর ভেঙ্গে গেলে বা বেদখল হলে অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটনা বেরিয়ে আসে যা দেখে জাতি হতাশ হয়। আবার ঘরের ভেতরের খবর বাইরে বেরিয়ে পরলে মানুষ স্তম্ভিত হয়। ফাঁস হওয়া ঘটনাবলী মানুষের আস্থা বিশ্বাস রাজনৈতিক কৃষ্টি, কালচার, রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও ধৃষ্টতাকে এমনভাবে ভুলন্ঠিত করে যেন আমরা মুখ ফিরিয়ে নিতে চাই, লজ্জায় বা ঘৃণায়।

সাম্প্রতিক সময়ে গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগে আভ্যন্তরীণ উত্তাপ রাজপথে নগ্নভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। সংবাদ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে অসংখ্য ছবি ভিডিও প্রচার প্রকাশ ও লাইভ ভিডিও প্রদর্শিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের একটি ইউনিটে ঘরোয়া বিবাদ রাজপথে সহিংসতায় রুপ নিয়ে কমপক্ষে ৩২জন আওয়ামীলীগ কর্মি রক্তাক্ত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি নিয়ে মিছিল হয়েছে। একজন আওয়ামীলীগ নেতার ছবি লাল ক্রস চিহ্ন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ছবি ব্যানার পুড়ানোর সংখ্যা একাধিক। একটি ছবি সম্বলিত ব্যানারে জুতাপেটা করার ছবি ও প্রশ্রাব করার ছবি পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের একটি ইউনিটের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দের ফসল যদি এমন অশালীন অশ্লীল ও নগ্ন হয়, তবে রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে জনগণ কি মনে করবে! সরকারী দলের ঝগড়া ফ্যাসাদের ফসল যদি এমন বিভৎস হয়, তবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাথে কোন দ্বন্দ ফ্যাসাদের ফসল কেমন হবে, তা নিয়ে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়ে গেল।

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, লাল সবুজের পতাকা ও বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে মিমাংসিত বিষয়। রাষ্ট্রের এই সম্পদগুলো নিরাপদ রাখতে সংবিধান ও আইনে প্রয়োজনীয় সুরক্ষার বিধান রয়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সনে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ হঠাৎ করে ঘরোয়া বিবাদে কেন এসব মৌলিক উপাদানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে তা নিয়ে সমালোচনা চলমান। আওয়ামীলীগের ঘরোয়া বিবাদ সহিংসতায় চলে গেলেও প্রচলিত আইন কেন দূরত্ব বজায় রাখল, তা নিয়েও জল্পনা কল্পনা আছে। ঘটনার শুরু থেকে ১৫ দিন অতিবাহিত হচ্ছে এর মধ্যে রক্তাক্ত জখম, জ্বালাও পোঁড়াও, অগ্নি সংযোগ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় চলমান।

ভাবতে আশ্চর্য লাগে বিষয়টি সম্পর্কে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ এর সভাপতি ও বাংলাদেশ সরকারে প্রধানমন্ত্রী সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেওয়ার পরও নালিশি বিষয় নিয়ে রাজপথে উত্তাপ থামছেনা । জন শৃঙ্খলা বিঘ্ন হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রহস্য জনক নিরবতা পালন করছে। ফৌজধারী অপরাধ সংঘটিত হলেও অভিযুক্তকে অপরাধ প্রমান করতে বলা হচ্ছে। তবুও আইনি বিচারের দ্বারে কাছে যাচ্ছে না কেউ। আমাদের বিচার ব্যাবস্থায় অভিযোগকারী (বাদী) অভিযুক্ত ব্যাক্তি (বিবাদী), স্বাক্ষী ও প্রমান বিচার বিশ্নেষন করে বিচারক বিচারকাজ সম্পন্ন করেন। কিন্তু এই ঘটনায় অভিযুক্তকে নিজের বিচার নিজেই করার জন্য বার বার আহবান করা, প্রমান করে বিচার বিভাগের প্রতি সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদদের কোথাও যেন অনিহা তৈরি হতে চায়।

সুতরাং প্রচলিত আইন ও সংবিধানের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রেখে রাজপথকে নিরুত্তাপ করে সাংগঠনিক প্রধান হিসেবে আওয়ামীলীগ এর সভাপতির প্রতি সুষ্ঠ সমাধান পাওয়ার প্রতিক্ষায় থাকা উচিৎ সংশ্লিষ্ট আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের । পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও নালিশি বিষয়ে সরকার প্রধানের গৃহীত পদক্ষেপকে সুরক্ষিত রাখা দরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *