স্কুল কলেজ খোলার দুই সপ্তাহের মধ্যেই বিভিন্ন জেলায় শিক্ষার্থীরা করোনায় আক্রান্তের খবরে অভিভাবকদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার মানিকগঞ্জে এক স্কুলছাত্রী করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ার পর দেশজুড়েই বিষয়টি বেশ আলোচিত হচ্ছে। অনেক অভিভাবক ভয়ে আতঙ্কে আদরের সন্তানকে স্কুলে না পাঠানোর জন্যও মনস্থির করছেন। এই অবস্থায় গতকাল শনিবার শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। অযথা উদ্বেগ বা আতঙ্কের কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। আমরা সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছি। স্কুল বন্ধ করে দেয়ার মতো কোনো অবস্থা এখনো সৃষ্টি হয়নি।
যদিও গত কয়েক দিনে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হানা দিতে শুরু করেছে করোনাভাইরাস। এর মধ্যে মানিকগঞ্জ এবং মাদারীপুরের দুই শিক্ষার্থীর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর দেশজুড়ে চাউর হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে একজন স্কুলশিক্ষকের পর গোপালগঞ্জে আরো দুই শিক্ষার্থী আক্রান্ত হয়েছেন। ঠাকুরগাঁও এবং চাঁদপুরেও ১৬ শিক্ষার্থী আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রকাশ হয়েছে। নীলফামারীতে সম্প্রতি তিন শিক্ষক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। উল্লেখিত পাঁচটি জেলার আক্রান্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ বন্ধ করে দেয় স্থানীয় প্রশাসন।
এ দিকে স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কোভিডে সংক্রমিত হওয়ার খবরের ‘কোনো সত্যতা নেই’ বলে দাবি করেছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। মহামারিতে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর দেশের স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া হয়েছে। এরপর গত দুই সপ্তাহে বিভিন্ন জেলার কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সংক্রমিত হওয়ার খবর আসে সংবাদমাধ্যমে। তবে এসব খবর শুধু ফেসবুকেই ছড়ানো হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। বিভিন্ন অনলাইন ও ফেসবুকে প্রচারিত শিক্ষার্থী করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরে কোনো সত্যতা নেই বলে দাবি করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি। গতকাল শনিবার তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন আপনারা (সাংবাদিকরা) যে খবর দিয়েছেন এখন পর্যন্ত কোথাও সে রকম কোনো পরিস্থিতি ঘটেনি। যদি কোথাও এমনটি হয় তবে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেন, ‘মহামারী এখনো কিন্তু চলমান। যদিও শনাক্তের হার পাঁচের নিচে নেমে এসেছে, তারপরও কিন্তু মহামারী চলমান সারা দুনিয়ায়। কাজেই আমাদের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখতে হবে। কেউ না কেউ অসুস্থ হতেই পারে। বাড়িতে হতে পারে, যাতায়াতের পথে হতে পারে; এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও হতে পারে। সেটি যেন না ঘটে এবং কোথাও ঘটনা ঘটলে আমরা যেন ব্যবস্থা নিতে পারি এ বিষয়ে সচেতন এবং দৃষ্টি রাখছি। আমরা কোনো অভিযোগ বা খবর পেলে স্থানীয় প্রশাসন, সিভিল সার্জেন্টের অফিস ও স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেবো।’
শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর প্রাথমিকভাবে নির্দিষ্ট শ্রেণিতে পাঠদান বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। আক্রান্ত শিশুর সহপাঠীদের রাখা হচ্ছে পর্যবেক্ষণে। নজরদারিতে থাকছে তাদের পরিবারের সদস্যরাও।
প্রতিবেদনে প্রকাশ, নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার চিড়াভিজা গোলনা দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের সুশান্ত কুমার রায়, রমিজুল ইসলাম ও আব্দুল জলিল তিনজন শিক্ষক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এ ঘটনায় দুই দিন বিদ্যালয় বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার রাতে ওই তিন শিক্ষকের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। তারা নিজ নিজ বাড়িতে আইসোলেশনে আছেন। এ বিষয়ে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আল হাসান জায়েদ বলেন, করোনা ভাইরাসের প্রাথমিক উপসর্গ দেখা দেয়ায় প্রথমে একজন শিক্ষক তার নমুনা পরীক্ষা করান। এতে তার করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। পরে আরো দুই শিক্ষকের করোনা শনাক্তের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর গতকাল শনিবার ও আজ রোববার দুই দিন স্কুল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
জলঢাকা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকতা চঞ্চল কুমার ভৌমিক জানান, যেহেতু বিদ্যালয়টির তিনজন শিক্ষক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত তাই বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক-কর্মচারীর নমুনা পরীক্ষার জন্য সংরক্ষিত ছুটি থেকে দুই দিন স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আগামী সোমবার থেকে ক্লাস শুরু হবে। যদি আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায় তাহলে উপজেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটির সাথে আলেচনা সাপেক্ষে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এর আগে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঁচ শিশু শিক্ষার্থীর করোনা শনাক্ত হয়েছে। বুধবার করোনার আক্রান্তের বিষয়টি জানার পর বিদ্যালয়টির দুই শ্রেণীতে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া গোপালগঞ্জে ২১ সেপ্টেম্বর পঞ্চম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর করোনা শনাক্ত হওয়ার পর ওই শ্রেণীতে পাঠদান বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর একই জেলায় তৃতীয় শ্রেণীর আরেক শিক্ষার্থীর করোনা শনাক্ত হয়। আর মানিকগঞ্জে করোনা উপসর্গে বুধবার মৃত্যু হয়েছে অষ্টম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর।
ঠাকুরগাঁওয়ে গত বুধবার করোনা শনাক্ত হওয়া পাঁচ শিশু উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের কলোনি এলাকার বাহাদুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক ফারহানা পারভীন জানান, আক্রান্তদের মধ্যে দু’জন চতুর্থ ও তিনজন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। তাদের বয়স ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। তারা সবাই ঠাকুরগাঁও সরকারি শিশু পরিবার সদস্য। তিনি আরো জানান, বিদ্যালয়টিতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ৪২৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে ওই দুই শ্রেণীতে বর্তমানে পাঠদান বন্ধ করা হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও সরকারি শিশু পরিবার বালিকার উপতত্ত্বাবধায়ক রিক্তা বানু জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানে থাকা শহরের হাজীপাড়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ১৬ সেপ্টেম্বর জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে অন্যদের পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওই পাঁচ ছাত্রী আক্রান্ত হয়। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসের সহকারী শিক্ষাকর্মকর্তা মমতাজ ফেরদৌস বলেন, বাহাদুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রী করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বলে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এরপর বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়। এক সপ্তাহের জন্য ওই বিদ্যালয়ের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর ক্লাস বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার রকিবুল আলম চয়ন বলেন, সরকারি শিশু পরিবারের শিশুদের আক্রান্তের দিন থেকেই শারীরিক অবস্থা পর্যক্ষেণ করা হচ্ছে। তারা বর্তমানে সুস্থ আছে।
গোপালগঞ্জ পৌরসভার ১০২ নম্বর বীণাপাণি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী মোনালিসা ইসলামের করোনা শনাক্ত হয় ২১ সেপ্টেম্বর। এরপর ওই শ্রেণীর পাঠদান বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে অন্য শ্রেণীতে পাঠদান চলছে। মোনালিসার মা মিতু খানম বলেন, এতদিন আমার মেয়ে সুস্থ ছিল। ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সে স্কুলে যাওয়া শুরু করে। এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে তার হালকা জ্বর, মাথাব্যথা। সে জন্য পরদিন তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিই। এক সপ্তাহেও মেয়ের জ্বর না কমায় ২১ সেপ্টেম্বর তার করোনা পরীক্ষা করাই। ওই দিনই পজিটিভ রেজাল্ট আসে। এর আগে ১৭ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার ৪ নম্বর ফেরধারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর এক ছাত্রীর করোনা শনাক্ত হওয়ায় ওই শ্রেণীর পাঠদান ১৪ দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়।
সর্বশেষ মানিকগঞ্জের এক স্কুলছাত্রীর মৃত্যুর পর মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ জানান, মারা যাওয়া শিক্ষার্থী রোদেলা করোনায় আক্রান্ত ছিল কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এর আগে ওই বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী করোনা পজিটিভ হওয়ায় ওই শ্রেণীর পাঠদান বন্ধ রাখা হয়। এরপর ওই শ্রেণীর ৫৮ শিক্ষার্থীর করোনা পরীক্ষায় সবার নেগেটিভ আসে। চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার ড. মনসুরউদ্দীন মহিলা কলেজের তিন ছাত্রী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এ ঘটনার পর ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন স্থানীয় শিক্ষাকর্মকর্তা। একই সাথে কলেজের ছাত্রীনিবাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।