দীর্ঘ ৯ বছরেও হচ্ছে না মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেই বিদ্যুৎ বিভাগের এখন এক যুগ লাগবে বলে জানানো হয়েছে। মেগা প্রকল্প মাতারবাড়ি ১২শ’ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটিতে সাত বছর এক মাসে অগ্রগতি মাত্র ৪৫ শতাংশ। অর্থ ব্যয় হয়েছে ৪৮.৫৩ শতাংশ। প্রকল্পটি অনুমোদনের পর বিস্তারিত ডিজাইন করা হয়। এই ডিজাইনের কারণে খরচ ১৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা বাড়ছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ পরিকল্পনা কমিশনের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ধীরগতির কারণে সময় সাড়ে তিন বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের কাছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি অনুমোদনের পর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিটেইল ডিজাইন করে। সে অনুযায়ী খরচ বেড়েছে প্ল্যান্ট ও জেটির ক্ষেত্রে। এখন তা একনেকের অনুমোদনের অপেক্ষায় বলে কমিশন জানায়।
সূত্রে জানা গেছে, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্লান অনুযায়ী আগামী ২০৩০ সালে দেশে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে। আর সে আলোকে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। বর্তমানে দেশে স্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হলো ২৫ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ দৈনিক চাহিদা সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ১৩ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে সরকার কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে দু’টি ৬০০ মেগাওয়াটের মোট ১২০০ মে.ও. আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট (প্রথম সংশোধন) ২০১৪ সালের ১২ আগস্ট একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্প ঋণসহ ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি ৪৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পটি সমাপ্ত করার সময় ছিল ২০২৩ সালের জুনে। কিন্তু এখন এটার খরচ ১৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আর মেয়াদ আরো সাড়ে তিন বছর বাড়িয়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। প্রকল্পে জাইকা থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে। সিপিজিসিএল প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী সংস্থা।
প্রকল্পের অগ্রগতির তথ্য থেকে জানা গেছে, যেখানে ২০২৩ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্তির সময় নির্ধারণ করা আছে, সেখানে ২০১৪ সাল থেকে চলতি ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত অর্থাৎ ৯ বছরের প্রকল্পে সাত বছর এক মাসে খরচ হয়েছে ৪৮.৫৩ শতাংশ বা ১৭ হাজার ৪৬৬ কোটি ২০ লাখ টাকা। যেখানে বিবিধ খাতেই খরচ বাড়ছে ১৯১ কোটি টাকা।
প্রকল্পের আওতায় কাজগুলো হলো, দু’টি ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, প্রকল্প এলাকার জন্য সমুদ্রে গভীর নাব্যতার চ্যানেল এবং তেল ও কয়লার জন্য পৃথক দু’টি জেটি নির্মাণ, স্থায়ী টাউনশিপ নির্মাণ, বিভিন্ন পূর্ত কাজ, ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন। প্রকল্পে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে নির্বাচিত জাপানি ঠিকাদার এবং বিশ্বের বিভিন্ন পরামর্শক রয়েছে। ইপিসি ঠিকাদার হলো, জাপানের সুমিতোমো করপোরেশন, তোশিবা এনার্জি সিস্টেম অ্যান্ড সলিউশন করপোরেশন এবং আইএইচআই করপোরেশন। আর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে জাপানের টেপসকো, নিপপন কওই, জার্মানির ফিথনার এবং অস্ট্রেলিয়ার এসএমইসি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোর্ট ও জেটি নির্মাণ প্রক্রিয়া সবচেয়ে দৃশ্যমান। সমুদ্রগামী বিভিন্ন জাহাজ থেকে প্রকল্পের মালামাল খালাসে গত ডিসেম্বর থেকে নবনির্মিত একটি স্থায়ী জেটি ইতোমধ্যেই ব্যবহার করা হচ্ছে। আরেকটি জেটি নির্মাণকাজ চলমান। প্রকল্প এলাকার জন্য সমুদ্রে গভীর নাব্যতার চ্যানেল এবং তেল ও কয়লার জন্য পৃথক দু’টি জেটি নির্মাণ, স্থায়ী টাউনশিপ নির্মাণ, বিভিন্ন পূর্ত কাজ, ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন কাজ চলমান আছে। প্রকল্প দেরিতে শুরু হওয়ার কারণ হলো, ২০১৬ সালে গুলশানের হোলে আর্টিসানের ঘটনায় ইপিসি বিড সাবমিশন দীর্ঘায়িত হয়। ইপিসি কাজ শুরু করে প্রকল্প অনুমোদনের তিন বছর পর, ২০১৭ সালের ২ আগস্ট।
প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা গেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইপিসির অংশ বয়লার নির্মাণে ব্যয় ৬৫০ কোটি ৮৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেখানে এই খাতে অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৮ হাজার ৩৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ইপিসি অংশে টারবাইন ও জেনারেটর নির্মাণে ব্যয় বরাদ্দ ছিল চার হাজার ৫৭৯ কোটি ছয় লাখ টাকা। এখন তাতে বৃদ্ধি পাচ্ছে ৬৪২ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আর কয়লা ও ছাই হ্যাণ্ডেলিং সিস্টেমের জন্য ব্যয় বরাদ্দ ছিল দুই হাজার ২২৩ কোটি ৫৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এখানেও খরচ বাড়ছে ১৯২ কোটি ২৯ লাখ ২৯ হাজার টাকা। ১২০ জনমাস প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের জন্য অনুমোদিত ব্যয় ছিল ১৪ কোটি ৮৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা। সেখানেও বাড়ছে সাত কোটি ৫০ লাখ টাকা। ট্রায়াল রান ইপিসির অংশে খরচ ধরা হয়েছিল এক হাজার ৯২৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এখন ব্যয় বাড়ছে ২৫২ কোটি ৮৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। বলা হচ্ছে ইপিসির চুক্তি মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যয় বৃদ্ধি। দেশী-বিদেশী পরামর্শক সেবায় ব্যয় বাড়ছে ৩২৭ কোটি ৮১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। ফলে পরামর্শক খাতে ব্যয় ৫০৭ কোটি ১১ লাখ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৮৩৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা; যা মোট খরচের ২ শতাংশ। নির্মাণকালীন সুদ দিতে হবে এক হাজার ৩৯২ কোটি ছয় লাখ টাকা।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিপিজিসিবিএল লিখিতভাবে তাদের বক্তব্যে কমিশনকে বলেছে, এই প্যাকেজের বিষয়ে প্রকল্প অনুমোদনের পর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিটেইল ডিজাইন তৈরি করে। সেই ডিটেইল ডিজাইন অনুযায়ী বিড ডকুমেন্টস তৈরি করে ইপিসি (ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকিউরমেন্ট কন্ট্রাক্টর) ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়। ঠিকাদারের সাথে চুক্তিমূল্য বেড়ে ৩৮ হাজার ১১৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে গুলশানে হোলেআর্টিসান ট্র্যাজেডির কারণে প্রকল্পে ইপিসি ঠিকাদার নিয়োগ দেরি হয়। ফলে ইপিসি ঠিকাদারের বিড মূল্যায়নের পর ওই ঠিকাদারের প্রস্তাবিত সময়সীমার মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইপিসি ঠিকাদারের সাথে চুক্তি করা হয়, যাতে সিপিজিসিবিএল বোর্ডের অনুমোদন এবং জাইকার সম্মতি রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ বলছে, পাওয়ার প্ল্যান্ট ও জেটি নির্মাণে প্রাক্কলিত খরচ ১৩ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা বাড়ানোয় ইপিসি চুক্তির যাবতীয় তথ্যাদির বিষয়ে আইএমইডিকে অবহিত করতে হবে। প্রকল্পটির সুষ্ঠু বাস্তবায়নে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি কর্তৃক নিয়মিত তদারকি প্রয়োজন। প্রকল্পের জন্য বিদেশে যন্ত্রপাতি নির্মাণকাজ কোনপর্যায়ে আছে তা নিয়মিতভাবে মনিটরিং করা প্রয়োজন।
প্রকল্পের ব্যাপারে সিপিজিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আবদুল মোত্তালিব এবং প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আযাদের সাথে যোগাযোগের জন্য ল্যান্ড ও মুঠোফোনে কয়েকদফা কল করা হলেও তারা কল রিসিভ করেননি। প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলীর সাথে কথা হলে তিনি প্রকল্প পরিচালকের সাথে কথা বলার জন্য বলেন।
প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধির ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্যসচিব শরিফা খানের কাছে গতকাল সন্ধ্যায় ফোনে জানতে চাওয়া হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রথমে যখন পিইসি হয় তখন আমাদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু অবজারভেশন দেয়া হয়েছিল। সে আলোকে তারা আরডিপিপি পাঠিয়েছে। আমরা সেটা পর্যালোচনা করে পাঠিয়েছি। বেশ কয়েকটি অঙ্গ নতুন করে যুক্ত হওয়ার কারণে ব্যয় বাড়ছে। তিনি বলেন, পিইসি করে আমরা পাঠিয়েছি একনেক ডিভিশনে। আগে ব্যয় ছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এখন বাড়ছে ১৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বেশি। তিনি বলেন, খরচ ৫২ হাজার কোটি টাকার মতো হবে। আমরা আমাদের অবজারভেশন প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানিয়েছি। আমাদের যা অবজারভেশন এবং আইএমইডির অবজারভেশন পাঠিয়েছি। এটা আগামী একনেকে উঠবে কি না জানি না।