করোনাকালে এই প্রথম বিদেশ সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে আজ নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা করছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর সফর প্রস্তুতির আপডেট জানাতে আয়োজিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে গতকাল বলা হয়, ফিনল্যান্ডে যাত্রা বিরতি শেষে আগামী ১৯শে সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে পৌঁছাবেন প্রধানমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেন, কোভিড বাস্তবতায় এবারের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল খুব ছোট আকারে গঠন করা হয়েছে। মন্ত্রী নিজে এবং প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হচ্ছেন বলে জানানো হয়। তবে এক প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ৭৯ থেকে ৮০ জনের একটি সরকারি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হচ্ছেন। ওই তালিকার বাইরে ৫০-এর অধিক সদস্যের একটি বিজনেস ডেলিগেশনও রয়েছে, যারা প্রতিবারের ন্যায় এবারো নিজ খরচে প্রধানমন্ত্রীর সফর সঙ্গী হবেন। সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন জানান, এবারে সম্মেলনে সার্বিক অর্থে বাংলাদেশের সফলতা তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কর্মসূচির বিস্তারিত তুলে ধরে মন্ত্রী মোমেন জানান, ফিনল্যান্ড হয়ে নিউ ইয়র্কে পৌঁছাবেন প্রধানমন্ত্রী। ২১শে সেপ্টেম্বর থেকে জাতিসংঘের ৭৬তম অধিবেশনের উচ্চ পর্যায়ের বিতর্ক-পর্ব শুরু হতে যাচ্ছে। ২৪শে সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিবেন। প্রতিবারের মতো এবারো প্রধানমন্ত্রী বাংলায় ভাষণ দেবেন। তিনি বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নয়ন অগ্রযাত্রা, একীভূত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, স্বাস্থ্যখাতে সাফল্য সম্পর্কে আলোকপাত করবেন। পাশাপাশি, বিশ্ব শান্তি, নিরাপদ অভিবাসন, করোনাভাইরাসের টিকার ন্যায্যতাভিত্তিক বণ্টন, বৃহৎ পরিসরে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনের লক্ষ্যে পেটেন্টসহ মেধাস্বত্ব উন্মুক্তকরণ, ফিলিস্তিনি ও বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের সংকট, জলবায়ু, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত বিষয়সমূহ তার ভাষণে উঠে আসবে। কোভিড-১৯ এবং আফগান পরিস্থিতির এই কঠিন সময়ে রোহিঙ্গা ইস্যু কতোটা গুরুত্ব পাবে। এবারের জাতিসংঘ সম্মেলনে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু যথাযথ গুরুত্ব পাবে। এ ইস্যুটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে এতটাই পরিচিত যে, এখন আর তা হারিয়ে যাওয়ার বিষয় নয়। তবে এটা সত্য যে, প্রত্যাবাসনে এখনো কোনো অগ্রগতি নেই। এবারের সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমারের কোন সরকার প্রতিনিধিত্ব করবে তা স্পষ্ট নয়। তাছাড়া আফগানিস্তানের কে এবারের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করবে তা-ও এখনো পরিষ্কার নয়। মন্ত্রী বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারো যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে একটি অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন। করোনা মহামারির প্রেক্ষিতে ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী প্রতিবারের ন্যায় বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ, ভিয়েতনামের রাষ্ট্রপতি নগুয়েন জুয়ান ফুক, বার্বাডোজের প্রধানমন্ত্রী মিয়া আমোর মোট্টেলে, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরাঁ, ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের সভাপতি চার্লস মাইকেসের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিয়ে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেন, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২১ প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরবেন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিরসনে সম্মিলিত বৈশ্বিক উদ্যোগের আহ্বান জানাবেন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী সমপ্রদায়ের আয়োজনে একটি গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন। এই বৈঠকে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীগণ বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়সমূহ তুলে ধরবেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীগণ তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাব বাংলাদেশের নিকট তুলে ধরবেন। এর মাধ্যমে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সদর দপ্তর চত্বরে বৃক্ষরোপণ করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী মোমেন বলেন- চীনের মধ্যস্থতায় মিয়ানমারের সঙ্গে এবার নিউ ইয়র্কে ত্রিপক্ষীয় কোনো বৈঠক হচ্ছে না। কারণ মিয়ানমারের কোন সরকার সেখানে প্রতিনিধিত্ব করবে তা এখনো ঠিক হয়নি। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি উচ্চ পর্যায়ের সাইড ইভেন্ট হবে, যাতে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সফর বিষয়ক ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম এমপি, জ্যেষ্ঠ সচিব মাসুদ বিন মোমেনসহ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশের ফোকাসে যা থাকছে- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়- ‘কোভিড মহামারি ও তৎপরবর্তী টেকসই উত্তরণ’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এ বছর সাধারণ বিতর্ক হবে। এবারের অধিবেশনের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকবে কোভিড-১৯ ও পরবর্তী টেকসই পুনরুদ্ধার ও পুনঃনির্মাণ নিয়ে আলোচনা। কোভিড-১৯ অতিমারি হতে মুক্তিলাভের জন্য বিশ্বব্যাপী ‘ভ্যাক্সিন বৈষম্য’ দূরীকরণের বিষয়টি এবারের অধিবেশনে বিশেষভাবে আলোচিত হবে। এবারের জাতিসংঘের প্রায়োরিটি ইস্যুগুলোর প্রত্যেকটি বাংলাদেশের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে বলা হয়- এই ইস্যুগুলোর উপর যেসব ইভেন্ট আছে বাংলাদেশ তার সবক’টিতেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে। আগামী ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০২১ উচ্চ-পর্যায়ের একটি সভায় প্রধানমন্ত্রী যোগ দেবেন। খাদ্য খাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য তুলে ধরার জন্য এই সম্মেলন হবে একটি অনন্য উপলক্ষ। একই দিনে আরেকটি সাইড ইভেন্টে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দেবেন। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ অধিবেশনের সাইড লাইনে সার্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে জানানো হয়েছে। স্মরণ করা যায়, ভারত ও পাকিস্তানের বৈরী অবস্থার এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপের কারণে করোনা শুরুর আগে ভারত, বাংলাদেশসহ অন্তত ৪টি দেশ ইসলামাদে প্রস্তাবিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বর্জন করেছে। মৃতপ্রায় সার্কের অবস্থা পর্যালোচনায় নিউ ইয়র্কে প্রস্তাবিত বৈঠকটি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।