বর্তমান সরকারের মেয়াদ তিন বছর পার হয়েছে। সে হিসাবে নির্বাচনের বাকি রয়েছে দুই বছরেরও কম সময়। এরইমধ্যে অনেকটা নীরবে শুরু হয়েছে জাতীয় নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রস্তুতি। মাঝে মধ্যবর্তী নির্বাচনের একটা গুঞ্জন তোলা হয়েছিলো সরকার বিরোধীদের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সামনে ধোপে টেকেনি ওই দাবি। ব্যাপারটি জ্বলেই নিভে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। টেলিভিশন টকশোগুলোতে এখন বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদরা অংশ নিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তারা কথা বলা শুরু করেছেন আগামী নির্বাচন নিয়ে।
কেউ কেউ জোটের বিষয়ও তুলে আনছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র সঙ্গে যারা জোটবদ্ধ হয়ে আছেন তারা এখন নড়েচড়ে বসছেন। হিসাব কষছেন আগামী নির্বাচনে বৈতরণ পার হওয়ার কৌশল নিয়ে। রাজনৈতিক প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়েও হিসাব করছেন তারা। এরইমধ্যে জোট নিয়ে দুই বড় দলের নির্বাচিত নেতারা কাজ শুরু করেছেন। নীরব দায়িত্ব পেয়ে ওই সব নেতারা আপাতত ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত। জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনের ছক কষছেন তারা। শিগগিরই এসব বিষয় সামনে চলে আসবে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদরা। তারা জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হতে পারে নানামুখী চমকের মধ্য দিয়ে। জোটগুলোতে হয়তো বড় ধরনের রদবদল হতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চমক থাকতে পারে বিএনপি-জামায়াতের বিচ্ছিন্নতা। সামনে এ নিয়ে বিএনপি’র পক্ষ থেকে ঘোষণা আসতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। এদিকে সমপ্রতি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ ৯ নেতা গ্রেপ্তারের পর রাজনৈতিক গুঞ্জনের ডালপালা আরও বেড়েছে। কারণ জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তারের পর জোট চালক হিসেবে পরিচিত বিএনপি’র পক্ষ থেকে জামায়াত নেতাদের নিয়ে সরাসরি কোনো বিবৃতি আসেনি। গ্রেপ্তারের পরদিন বিএনপি মহাসচিব একটি কৌশলী বিবৃতি দেন। তাতে জামায়াত ও জামায়াত নেতাদের কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। ওই বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সমপ্রতি সরকার বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদেরকে গ্রেপ্তারে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। গতকালও (গত সোমবার) বিরোধী দলের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশির নামে হয়রানি করা হচ্ছে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নেতৃত্বকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে এবং নেতাকর্মীদের মনোবল ধ্বংস করতেই বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার বিএনপি এবং বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করছে। তিনি বলেন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদেরকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তারের ঘটনায় আমি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে তাদের বিরদ্ধে দায়েরকৃত বানোয়াট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহারসহ নিঃশর্ত মুক্তির জোর দাবি করছি। রাজনীতিবিদরা জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি’র এ কৌশলকে বিচ্ছিন্নের সুর বলে ভাবছেন। এদিকে জামায়াতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপি’র নেতারা মুখে অনেকটা কুলুপ এঁটেছেন। মিডিয়ার সামনে তারা এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না। তবে আগামী নির্বাচন ঘিরে জোটের রূপরেখা নিয়ে অনেকটা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির শীর্ষ নেতারা মানবজমিনকে বলেন, রাজনৈতিক পট খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়। নির্বাচনের দেড় বছরেরও বেশি সময় বাকি রয়েছে। তাই জোট নিয়ে চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশের সময় এখনো আসেনি। বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, রাজনৈতিকভাবে দুই দলই এখনো একাট্রা। বিএনপি যদি জামায়াতকে তাদের জোট থেকে সরিয়ে দেয় তাহলে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হতে পারে। আগে বিএনপি জামায়াত ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিক তারপর আওয়ামী লীগ তাদের অবস্থান স্পষ্ট করবে। ২০দলীয় জোটের শরিকদের অনেকে এরইমধ্যে বিএনপিকে জামায়াত থেকে সরে আসার পরামর্শ দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)’র একাংশের মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম মানবজমিনকে বলেন, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হতে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বড় চমক হতে পারে ২০দলীয় জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেয়া। এই দলটি এ পর্যন্ত কোনো সফল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। উল্টো জামায়াতের কারণে বিএনপি’র রাজনীতি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শরিকদের অনেকেই বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে। এখন সময়ই বলে দেবে ওই পরামর্শের ভবিষ্যৎ কী হবে। তবে আগামী নির্বাচনে সব দলকে রাজনৈতিকভাবে কঠিন হিসাব-নিকাশের মধ্যে ফেলে দেবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। এদিকে নির্বাচনের দেড় বছরের বেশি সময় থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে হঠাতে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনে রাজি বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন। বিএফইউজে’র চার যুগপূর্তি উপলক্ষে জাতীয় প্রেস ক্লাবে মঙ্গলবার গোলটেবিল আলোচনায় তিনি বলেন, আমাদের সামনে একটাই লক্ষ্য স্বৈরাচারের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা। এই সরকারের পতন না ঘটিয়ে এদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। আমরা কি পারি না এই সরকারকে হটানো ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতে? যদি ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ আপাতত করা সম্ভব না হয়, যুগপৎ আন্দোলন করতে পারি। এটাই এখন সময়ের দাবি। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্যে বলেন, এটা শুধু বিএনপি’র দাবি নয় যে, এই সরকারকে হটাতে হবে। এই ইস্যুতে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ইস্যুতে আমার মনে হয় কোনো দলের দ্বিমত নেই। বিএনপি নেতার এ ধরনের মন্তব্যের জবাবে ও জোট থেকে জামায়াতকে সরিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আঃ রহমান বলেন, বিএনপি ও জামায়াত দুটি দলই রাজনৈতিকভাবে নাজুক অবস্থা অতিক্রম করছে। তারা প্রচণ্ড অগোছালো। নানা মতের নানা চিন্তার মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দল দুটিকে প্রবাহিত করছে। এ অবস্থায় বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনের শক্তি আছে কিনা তা ভাবতে হবে। তিনি বলেন, জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের একটি দল। তারা জোটবদ্ধ হয়ে আছে বিএনপি’র সঙ্গে। এখন বিএনপি যদি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধে বিশ্বাসী হয় তাহলে জামায়াতকে ছাড়া উচিত। আমরা দেখতে চাই সামনের দিকে জামায়াত নিয়ে বিএনপি’র অবস্থান কি হয়। এদিকে সম্প্রতি এক টেলিভিশন টকশোতে ১৪ দলীয় জোট নিয়ে মন্তব্য করেছেন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। সেখানে তিনি জামায়াতকে ইঙ্গিত করে বলেন, এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক যে অবস্থান তাতে মনে হচ্ছে বিপদ এখনো কাটেনি। আমরা এই সরকারের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিপক্ষে তবে আদর্শিকভাবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে জোট গঠন করা হয়েছে তার পক্ষে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে আমরা সমর্থন করতে পারি না। এ অবস্থার পরিবর্তন হলে সময়ই অনুযায়ী আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। রাজনীতি বিশ্লেষকরা জানান, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধারক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় পরবর্তীতে দেশীয় জোট রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ ও মেরুকরণ তৈরি করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরে মন্ত্রিত্ব ভাগাভাগির প্রশ্নে জোটের শরিকদের ভেতর মন কষাকষির জন্ম হয়। জোটের শরিকদের ভেতর থেকে একমাত্র জাতীয় পার্টির জি এম কাদের এবং সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া ছাড়া কেউ মন্ত্রিত্ব পাননি। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধারক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দিলে বিরোধী দলগুলো জোরেশোরে সরকার বিরোধী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। ২০১২ সালে বিএনপি চারদলীয় জোটকে বিলুপ্ত করে ১৮ দলীয় জোট গঠন করে। জোটের শরিক দলগুলো হলো বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, বিজেপি, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, এলডিপি, কল্যাণ পার্টি, জাগপা, এনপিপি, লেবার পার্টি, এনডিপি, বাংলাদেশ ন্যাপ মুসলিম লীগ, ইসলামিক পার্টি, ন্যাপ ভাসানী, ডেমোক্রেটিক লীগ ও পিপলস পার্টি। এরা সবাই বিএনপি’র নেতৃত্বে সরকার বিরোধী আন্দোলনে নামে। ১৮ দলীয় জোট পরবর্তীতে ২০ দলীয় জোটে পরিবর্তিত হয়। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বয়কট করে এ জোট। ফলে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীগণ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩টি আসনে জিতে যায় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। দশম জাতীয় সংসদ ছিল ২০ দলীয় জোটশূন্য। পরে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোট গণফোরাম সভাপতি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’-এ যোগ দেয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী শুরুতে ঐক্যফ্রন্টে থাকেন। পরে মতের মিল না হওয়ায় ফ্রন্ট ছেড়ে আওয়ামী জোটে শরিক হন। ঐক্যফ্রন্টের অন্য শরিক দলগুলো হলো গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট লাভ করে সাতটি আসন।