সিলেটেও ভোটের ‘অচেনা’ পরিবেশ

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


সিলেট: সিলেটের নির্বাচনেও বদলায়নি দৃশ্যপট। সেই একই চেহারা। কেন্দ্র ভোটারশূন্য। ফাঁকা কেন্দ্রে অলস সময় কাটাচ্ছেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা। অথচ নির্বাচনী মাঠে ভোটারের জোয়ারে অনুমান করা হচ্ছিল কেন্দ্রে যাবে ভোটার। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের আশা করেছিলেন সবাই। এবার সিলেটেও সেই আশায় গুড়েবালি। প্রার্থীরা কেন্দ্রে ভোটার টানতে নানামুখী প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন।

আশ্বস্তও করেছিলেন ভোটারদের। কিন্তু মাঠে সরব থাকলেও ভোটের আগে নীরব হওয়া ভোটাররা ফিরলেন না কেন্দ্রে। এদিকে, কেন্দ্রে ভোটার যাওয়ার ব্যাপারে পরিবেশ নিয়ে অভিযোগ তুলেছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী আতিকুর রহমান আতিক। দুপুরের পর থেকেই তার সুর পাল্টে যেতে থাকে। একের পর এক অভিযোগ তিনি দিনভর জানিয়ে গেছেন। এমনকি কেন্দ্র গিয়েও তিনি নিজের ভোট খুঁজে পাননি। পরে বিকালের দিকে অবশ্য তিনি ভোট দিতে পেরেছেন। ইমিএম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শফি আহমদ চৌধুরীও। তবে- জয়ের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব। সিলেট-৩ আসনের সাবেক এমপি মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর গতকাল এ আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সকাল তখন ৮টা। সিলেটের বরইকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল এক অচেনা পরিবেশ। বাইরে আনসার সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছেন। ভেতরে কেবল নির্বাচনী কর্মকর্তা ও এজেন্টরা বসা। কোনো ভোটার নেই। ভোটগ্রহণ শুরুর প্রায় ১৫ মিনিট হয়ে গেল কোনো ভোটার কেন্দ্রে এলেন না। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে কয়েকজন ভোটার এসে ভোট দিয়ে যান। সকালে এভাবেই ভোটগ্রহণ শুরু হয় এ আসনের দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলার ১৪৯টি ভোট কেন্দ্রে। তবে- সকাল ৯টার পর থেকে ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে থাকেন। সকাল ১১টা পর্যন্ত কেন্দ্রে কিছুসংখ্যক ভোটার ছিলেন। তবে ভোটারের সারি দীর্ঘ হয়নি। যারা কেন্দ্রে এসেছিলেন ৫-৬ মিনিট কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ভোটাররা ভোট দিয়ে যেতে পেরেছেন। সকাল ১১টার পর কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি কমতে থাকে। যারা কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোট দিতে এসেছিলেন তারা ফিরে যাওয়ার পর আর ভোটারদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়নি। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে দক্ষিণ সুরমার মোগলাবাজারে রেবতি রমন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভোট দিতে আসেন আতিকুর রহমান আতিক। এ সময় ইভিএম জটিলতায় তিনি কেন্দ্রে তার ভোট খুঁজে পাননি। পরে বেরিয়ে এসে তিনি সাংবাদিকদের কাছে নানা অভিযোগ করেছেন। আতিক জানান, ৩টি উপজেলার বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র থেকে তার এজেন্টদের বের করা হয়েছে। কোথাও কোথাও অস্ত্র দিয়ে মহড়া দেয়া হয়েছে। যেসব কেন্দ্রে তার ভোটারদের উপস্থিতি বেশি সেসব কেন্দ্রে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘কুছাই এলাকার দুটি ভোটকেন্দ্র থেকে সকালে লাঙ্গলের প্রার্থীর দুই এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়েছে। ওই দুটি কেন্দ্রে ওপেন ভোট হয়েছে। নিয়ম হলো পর্দার ভেতরে গিয়ে ভোটাররা তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। তিনি বলেন সেটি হয়নি। ফলে লাঙ্গলের ভোটাররা গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। বাধ্য হয়ে অনেককেই নৌকার এজেন্টের সামনে ভোট দিতে হয়েছে।’ আতিক জানান, ‘বরইকান্দি কেন্দ্রে তার এজেন্টকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সমর্থকরা দা নিয়ে তাদের ধাওয়া করেছে। এতে ভয়ে অনেকে কেন্দ্র ছেড়ে চলে গেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।’ দুপুরে ফেঞ্চুগঞ্জের ৭টি ও বালাগঞ্জের কয়েকটি কেন্দ্রে তার এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ তোলেন আতিক। বিকালে তিনি জানান, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জের অনেক কেন্দ্রে তার এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে অবস্থান করতে দেয়া হয়নি। এজেন্টরা চলে যাওয়ার পর তার ভোটাররাও কেন্দ্রে যাননি। যারা গিয়েছিলেন তাদের ভোট জোরপূর্বক নৌকায় কাস্ট করা হয়। এদিকে, নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা না জানালেও ইভিএম নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শফি আহমদ চৌধুরী। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘মানুষ ভোটের মাধ্যমে তার মতের প্রতিফলন ঘটাবে। কিন্তু সেই প্রতিফলনে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে ইভিএম। গ্রামের মানুষের ইভিএম সম্পর্কে দক্ষ না থাকার কারণে তাদের মতামতের প্রতিফলন হয়নি। এছাড়া নারী ভোটাররা গিয়ে কেন্দ্রে ব্যালটের খোঁজ করেন। কিন্তু তারা ব্যালট পাননি।’ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতির জন্য খুব জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সকাল ৯টায় কামালবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিব। ভোট প্রদান শেষে তিনি সাংবাদিকদের কাছে জয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তবে, এ সময় হাবিব প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটে কালো টাকা ছড়ানোর অভিযোগ তোলেন। রাতে আতিকের পক্ষের লোকজন ভোট কিনতে টাকা নিয়ে এলাকায় এলাকায় গিয়েছিল বলে দাবি করেন তিনি। বিষয়টি প্রশাসনকে জানানোর পর অনেক স্থানে আতিকের লোকজনকে ধাওয়া করা হয়েছে বলে জানান তিনি। সিলেটে ভোটের পরিবেশ স্বাভাবিক ছিল মন্তব্য করেন হাবিব। জানান, সিলেটে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোথাও কোনো গোলযোগের ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচনে উন্নয়নের প্রতীক নৌকা মার্কার জয় হবে বলে আশাবাদ জানান তিনি। এদিকে, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনকালে দেখা গেছে কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। কোনো কোনো এলাকায় ভোট কেন্দ্রে ভোটারই ছিল না। অলস সময় কাটিয়েছে পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বালাগঞ্জের গহরপুরে আব্দুর রহিম উচ্চ বিদ্যালয়ের কেন্দ্রে মোট ভোট ৩৬০টি। বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ওই কেন্দ্রে ভোট পড়েছিল ৬৪টি। এই কেন্দ্রের আশপাশের কয়েকটি কেন্দ্রের পরিবেশও ছিল একই রকম। ভোটাররা কেন্দ্রে যাননি। কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি কম হওয়ার ব্যাপারে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী অভিযোগ করেছেন, ইভিএমে ভোট হওয়ায় অনেকেই কেন্দ্রে আসেননি। এছাড়া ভোটের পরিবেশও স্বাভাবিক ছিল না। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটাররা গিয়ে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিলেও ভোট দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কর্মীরা। তারা প্রকাশ্যভাবেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে অবস্থান নেয়ার কারণে ভীতিকর পরিস্থিতি ছিল বলে দাবি করেন তারা। বিকালে ভোট দিলেন আতিক: সকালে মোগলাবাজারে নিজের কেন্দ্রে ভোট দিতে গিয়েছিলেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী আতিকুর রহমান আতিক। এ সময় ভোটার দিয়ে ইভিএমে তার ভোটের অনুসন্ধান চালালেও পাওয়া যায়নি। এজন্য প্রায় আধাঘণ্টার মতো ভোটকেন্দ্রে অবস্থান করেন আতিক। তবু তিনি ভোট দিতে পারেননি। ভোট না দিয়েই কেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসেন তিনি। এদিকে, বিকালে নির্বাচনী কর্মকর্তারা তাকে ফোন করে ভোট দেয়ার আহ্বান জানালে তিনি কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে আসেন। নিজের ভোট দিতে পেরে আতিক সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও ভোটে কারচুপি, কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ তোলেন। এদিকে, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আতিকুর রহমান আতিক আগে হবিগঞ্জের ভোটার ছিলেন। এই নির্বাচনের আগে তিনি নিজের ভোট এলাকায় স্থানান্তরিত করেন। এ কারণে তফশিল ঘোষণার পর তার ভোট আর কাউন্ট করা হয়নি। পরে অবশ্য নির্বাচন কমিশন এই জটিলতা দূর করার পর তিনি ভোট দিতে পেরেছেন। সফলতা দেখছে বিএনপি: সিলেটের ভোটকেন্দ্রে ভোটার না আসাকে সফলতা দেখছে বিএনপি। বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, ভোটের পরিবেশ নিয়ে জনগণ ত্যক্ত বিরক্ত। এ কারণে মানুষ ভোট প্রদানে আগ্রহী নয়। জনগণ ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত থেকে নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছে। সিলেট জেলা বিএনপির সিনিয়র সদস্য আব্দুল কাইয়ূম জানিয়েছেন, সিলেট-৩ আসনের নির্বাচনে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রই ছিল ফাঁকা। এর থেকে প্রমাণ হয় মানুষ ভোটে আগ্রহী নয়। এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়- এটি আবারো প্রমাণিত হলো। ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকায় তিনি সিলেট-৩ আসনের জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *