প্রায় দেড় বছর পর খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে খোলার প্রস্তুতি। করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়নি এমন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন নতুন শঙ্কায়। খোলার পর শিক্ষার্থী মিলবে তো! এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অনেকে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। খোলার পর কতভাগ শিক্ষার্থী আবার আসে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় এসব প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা।
পশ্চিম তেঁজতুরী বাজারের এ্যাঞ্জেলস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক উপেন্দ্রনাথ বাড়ৈ মানবজমিনকে বলেন, ২০০৬ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আছি। ২০২০ সালে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব গ্রহণ করি।
তার কিছুদিন পরে করোনা সংক্রমণ শুরু হয়। মার্চের দিকে সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৯ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি শুরু হয়। করোনা শুরুর প্রথমদিকে মনে করেছিলাম হয়তো তিন মাস পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এত ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে কখনো ভাবতে পারিনি। আমরা সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে গেছি। এই মহামারির শুরু থেকেই আমাদের জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলতে হচ্ছে। এদিকে বাড়িওয়ালাকেও ঠিকমতো ভাড়া দিতে পারছি না। স্টাফদের বেতন দিতে পারছি না। বিশ সালের শেষদিকে অনেক অভিভাবক গ্রামে চলে যায় কর্মসংস্থান হারিয়ে। বিশ শতাংশ অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বলে আমরা গ্রামে চলে এসেছি। সুযোগ-সুবিধা হলে পরের বছরে ঢাকায় আসবো। আর ২৫ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রী স্কুল খোলার অপেক্ষায় ঠিকমতো পড়াশোনা করছে না। স্কুলে যোগাযোগও রাখছে না। অনলাইন ক্লাসেও তাদের সংযোগ নেই। বাকিগুলো মোটামুটি যোগাযোগ রাখছে কিন্তু অর্থনৈতিক দিকটা তাদের অনেকের সচল নেই। ফলে স্কুলের বেতনটা ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না। কেউ কেউ অনলাইন ক্লাস করার বিপক্ষে। আমরা যখন অনলাইন ক্লাস করি তখন দেখা যায় ৫০ শতাংশ স্টুডেন্ট অনলাইন ক্লাসে নেই। তাদের অভিভাবককে বললে বলে, আমার বাচ্চাদের হাতে মোবাইল দেয়া যাবে না। অথবা মোবাইল নেই। নেটওয়ার্কে সমস্যা ইত্যাদি।
তিনি বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর ছাত্র-ছাত্রী ছিল ২৫০-এর বেশি। স্টাফ ছিলাম ১৯ জন। এখনো স্টাফদের চাকরিচ্যুত করা হয়নি। কিন্তু এখন তাদের বেতন দেয়া হয় না। সবাই পরিস্থিতি বুঝে চলছে, না হলে আমাদের এতদিনে স্কুল বন্ধ করে চলে যেতে হতো। আমাদের তো সরকারি কোনো সহায়তা নেই। তিনি বলেন, এমন স্টুডেন্টও আছে যারা ২০২০ সালের বেতনটাও এখনো দিতে পারেনি। তাদের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে। তাদের এই অসহায়ত্ব দেখে আমরাও চাপ প্রয়োগ করতে পারি না। আমরা চিৎকার করে আমাদের অভাবের কথা কাউকে বলতেও পারি না। স্কুলের আয়াদেরও ঠিকমতো পারিশ্রমিক দিতে পারছি না। আমাদের অনেক দেনা হয়ে যাচ্ছে। তবুও অপেক্ষায় আছি সুদিনের। তিনি বলেন, স্কুল খোলার পর কতভাগ শিক্ষার্থী আবার ফিরে আসে এটা দেখার অপেক্ষায় আছি।
মিরপুর মেধা সিঁড়ি প্রি-স্কুলের কো-অর্ডিনেটর জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, সঞ্চয় যা ছিল সব শেষ। এখন লোন নিয়ে স্কুল টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে। নয় বছর হলো এই প্রতিষ্ঠানটি শুরু করি। এরমধ্যে এত বিপদের সম্মুখীন কখনও হয়নি। চোখেমুখে শুধু হতাশা দেখছি। করোনার আগে ছাত্র-ছাত্রী ছিল প্রায় ১৫০-এর মতো। আর এখন স্টুডেন্ট সবমিলিয়ে ৩০-৪০ জন আছে। বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তারা আমাদের সঙ্গে নেই। যখন দেখেছি আর ভাড়া দেয়া সম্ভব হচ্ছে না তখন মাঝে পাঁচ মাস স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলাম। গত মাসে আবার নতুন করে স্কুলের জন্য বাসা নিয়েছি। একদম অল্প জায়গার মধ্যে কোনোমতে টিকে থাকার জন্য। প্রথমদিকে অনলাইনে ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ ছিল কিন্তু এখন আর তারা বোরিং হয়ে ক্লাসে জয়েন করছে না। অনেকে তো আগে থেকে ঝরে পড়েছে। প্রথম সমস্যা হলো স্টুডেন্ট নেই। তাহলে আমরা কীভাবে চলবো। নিজেদের পকেট থেকে ভাড়া দিতে হচ্ছে। স্কুল খুলে দিলে আমাদের চলতে সুবিধা হবে। বাসা ভাড়াটাই আমাদের এখন বড় সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ স্টুডেন্ট বেতন দিতে পারছে না। যাদের বাবা সরকারি চাকরি করে তাদের বেতনটা মোটামুটি পরিশোধ করছে। এখন সব শিক্ষার্থী আবার ক্লাসে ফেরে কি-না তা নিয়েও ভাবছি।
শুতোষ কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পরিচালক নাজমুল হক মামুন জানান, ২০২০ সালের মার্চের ১৬০-১৭০ জন স্টুডেন্ট ছিল। এখন অনেক কমেছে। অনেক অভিভাবক পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। অনেকের অনলাইনে ক্লাসে মনোযোগ নেই। বেশিরভাগ পরিবার স্মার্ট ফোন সংকট, আর্থিক সমস্যার কারণে বাচ্চাদের অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত করতে পারছে না। ছোট বাচ্চাদের ফোন হাতে দিতেও অনেক অভিভাবক রাজি নন। আমাদের স্কুল শুধু অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে। স্টাফদেরও ঠিকমতো বেতন দিতে পারছি না। কোনো আয় নেই আমাদের। করোনার জন্য ১২-১৫ জন টিচারকে বাদ দিতে হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রী না থাকলে তাদের বেতন দেবো কীভাবে? করোনা পরিস্থিতি যখন ভালো হবে তখন তাদের আবার ডাকা হবে। কর্মচারীর বেতনও ঠিকমতো দিতে পারছি না। এত খারাপ পরিস্থিতি কখনওই আর হয়নি। তবুও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে ভালো দিনের অপেক্ষায়। এই পরিস্থিতিতে টিকে থাকা অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতি আরও কয়েক মাস গেলে আমাদের আর কোনো অস্তিত্ব হয়তো থাকবে না। স্কুল ছেড়ে দেয়ার উপক্রম হবে।
আফরোজা বেগমের খুব ইচ্ছে ছিল ঢাকায় বাচ্চাদের জন্য একটা স্কুল করবেন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে একটি স্কুলের যাত্রাও শুরু করেন তিনি। এরপর দু’মাস অতিক্রম করতে না করতেই স্কুল বন্ধ করে তাকে পরিবার নিয়ে চলে যেতে হয় গ্রামে। তিনি জানান, শখের পেশাটাকে এত দ্রুত ছেড়ে আসতে হবে কখনো ভাবতে পারিনি। পাঁচজন স্টুডেন্ট নিয়ে স্কুলটির যাত্রা শুরু করেছিলাম। নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির জন্য ভালো সাড়াও পেয়েছি। হঠাৎ করোনার কারণে বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। তখন করোনার আতঙ্কটা বেশি ছিল। স্কুলের ভাড়াটাও ঠিকমতো দিতে পারছিলাম না। পরে সিদ্ধান্ত নিই ছেড়ে দেয়ার। পাঁচ-ছয় মাস পড়ে স্কুল ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে আসি। পরিস্থিতি যদি কখনো ভালো হয় তখন আবার ঢাকায় ফিরে স্কুল শুরু করবো। এই সুদিনের অপেক্ষায় আছি।
দ্বিতীয় শ্রেণির একজন ছাত্রীর অভিভাবক জানান, বাচ্চাদের অনলাইন ক্লাসে বসিয়ে রাখা অত্যন্ত কঠিন। স্কুলে গেলে আমার বাচ্চা আর পাঁচজনের সঙ্গে খেলতে খেলতে তবুও কিছু শেখে। বাচ্চাকে কখনো বাড়িতে ফোনের সামনে বসিয়ে রাখা যায় না। শুধু ছোটাছুটি করে। এভাবে ক্লাস করিয়েও কোনো লাভ নেই। এজন্য স্কুল থেকে তাকে নিয়ে এসেছি। বাসায় বসে পড়াই। করোনার কারণে আর্থিক দিকটাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। বেতন দেয়া কষ্টকর হয়ে যায়। বাচ্চা যদি কিছু না শিখতে পারলো তাহলে তাকে স্কুলে রেখেও কোনো লাভ নেই। করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে বাচ্চাকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দেয়ার ব্যবস্থা করবো। আপাতত বন্ধ রেখেছি।