রাজশাহী:প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমুদ্র বিজয়ের গল্প শুনে কৃত্রিম জলাধার তৈরি করে বাণিজ্যিকভাবে সামুদ্রিক শৈবাল স্পিরুলিনা চাষ করে ভাগ্য বদলাচ্ছেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার আমশো গ্রামের রাকিবুল সরকার। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত এ সামুদ্রিক শৈবাল স্পিরুলিনা চাষ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে মাসে প্রায় ৮০ হাজার টাকা আয় করছেন তিনি।
সামুদ্রিক শৈবাল চাষে সফলতা বিষয়ে তরুণ এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমুদ্র বিজয়ের পর দেশে ব্লু ইকোনমির অপার সম্ভাবনার কথা বলতেন। কিন্তু ব্লু ইকোনমি কী সেটা আমি প্রথমে জানতাম না। তখন ব্লু ইকোনমি সম্পর্কে জানতে গিয়ে দেখি এটি সমুদ্রের ভেতর যে প্রাণিজ ও খনিজসম্পদ রয়েছে সেগুলো যথাযথভাবে আহরণ করে তার ব্যবহার করা। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সামুদ্রিক শৈবাল। সামুদ্রিক শৈবালের মধ্যে প্রয়োজনীয় খনিজ, প্রাণিজসহ মানবদেহের সব পুষ্টিকর উপাদানই রয়েছে। সামুদ্রিক শৈবালের আবার দুটি প্রকারভেদ আছে একটি হচ্ছে বৃহৎ আকারের সামুদ্রিক শৈবাল চাষ আর একটি হচ্ছে এককোষী সামুদ্রিক শৈবাল- যা স্পিরুলিনা নামে পরিচিত। এটি এককোষী প্রাণী পানিতে শ্যাওলার মতো ভেসে থাকে। তখন থেকে আসলে স্পিরুলিনা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি- ভারত, চীনসহ ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশেই এটি চাষ হচ্ছে। তখন ঝিনাইদহের দেলোয়ার অ্যাগ্রো ফুড নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে একদিনের প্রশিক্ষণ নিয়েই সামুদ্রিক শৈবাল চাষ শুরু করি।’
স্পিুরুলিনা চাষের জন্য ১৭ হাজার লিটারের একটি কৃত্রিম জলাধার তৈরি করেছেন রাকিবুল সরকার। এ জন্য জলাধারে রাসায়নিক প্রয়োগ করে সামুদ্রিক পরিবেশ তৈরি করতে হয়েছে তাকে। কৃত্রিম জলাধারে সামুদ্রিক পরিবেশ তৈরির জন্য তাকে পানির সঙ্গে ৯ ধরনের রাসায়নিক উপাদান মেশাতে হয়েছে। এ ছাড়া কৃত্রিম জলাধারটি স্বচ্ছ প্লাস্টিকের তৈরি টিন দিয়ে ছেয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে সরাসরি সূর্যালোক পড়ে জলাধারটিতে। এ ছাড়া পোকামাকড় ও জীবাণুর সংস্পর্শে যাতে না আসে সে জন্য জলাধারটি প্রথমে স্বচ্ছ মোটা পলিথিন ও তার ওপরে আবার প্লাস্টিকের নেট দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। আর পানিতে যাতে সব সময় অক্সিজেনের প্রবাহ ঠিক থাকে সে জন্য অক্সিমিটার জেনারেটর পানিতে বসানো হয়েছে। এ যন্ত্রের মাধ্যমে পানিতে অক্সিজেনের প্রবাহ তৈরি হচ্ছে।
রাকিবুল বলেন, ‘চলতি বছরের ১ মার্চ কৃত্রিম জলাধারে এটির চাষ শুরু করি। এটির জন্য প্রথমে কৃত্রিম জলাধার তৈরি করতে হয়েছে। এটি তৈরি করতে আমার দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কারণ প্লাস্টিকের টিন ঢাকা থেকে অর্ডার দিয়ে তৈরি করে আনতে হয়েছে, যা ব্যয়বহুল। এ ছাড়া জলাধারটিতে সামুদ্রিক পরিবেশ তৈরি করতে ৯ ধরনের রাসায়নিক উপাদান পানির সঙ্গে মেশাতে হয়েছে। এতে খরচ হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। আর ১৭ হাজার লিটার জলাধারের জন্য ১৫ লিটার স্পিরুলিনার বীজ দিতে হয়েছে। সব মিলিয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ পড়েছে।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে জলাধার থেকে প্রতি মাসে শুকানোর পর ১৫ থেকে ২০ কেজি স্পিরুলিনা উৎপাদন হয়। প্রতিকেজি স্পিরুলিনা বিক্রি হয় চার হাজার টাকা কেজি হিসাবে। সে হিসেবে প্রতি মাসে ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা স্পিরুলিনা বিক্রি হয় তার। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি ও পুষ্টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান স্পিরুলিনা ক্রয় করছেন বলে তিনি জানান। রাকিবুল পরামর্শ- স্পিরুলিনা ব্যাপক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হওয়ায় দেশসহ বহির্বিশ্বে এর চাহিদা ব্যাপক। সরকারের সহযোগিতায় দেশে এটির চাষ বৃদ্ধি করা গেলে এটির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি দেশে বেকার সমস্যার কিছু সমাধান হবে বলেও আশাবাদী তরুণ এ উদ্যোক্তা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাবরিনা নাজ এ সম্পর্কে বলেন, ‘অনেক ধরনের এককোষী শৈবাল রয়েছে, তার মধ্যে স্পিরুলিনা একটি। এটি ৮০ ভাগ প্রোটিন দ্বারা গঠিত বলে অনেক দেশেই এটা সাপ্লিমেন্টারি ফুড হিসেবে খাওয়া হয়। এটি ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান হিসেবে বিবেচিত হবে। আমরা ওই তরুণ উদ্যোক্তা থেকে স্পিরুলিনা নিয়ে এসে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখেছি- সেটা খাওয়ার যোগ্য। সেখানে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি।’