আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কমিশন গঠনসহ সরকারের কাছে ছয় দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। অন্য দাবিগুলো হলো: গুমের শিকার সব ব্যক্তিকে অবিলম্বে খুঁজে বের করে তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া, এ-সংক্রান্ত অভিযোগ দায়েরের জন্য একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং তা ব্যাপকভাবে প্রচার করা, দায়ীদের বিচারের সম্মুখীন করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গুমের শিকার ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের যথাযথ পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করা, গুমের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোকে অস্বীকার না করে এ ধরনের ঘটনার বিচার নিশ্চিতে বিদ্যমান আইন কাঠামোতে পরিবর্তন আনা এবং ‘অপহরণ’ হিসেবে নয়, ‘গুম’কে সুনির্দিষ্ট অপরাধ হিসেবে আইনে অন্তর্ভুক্ত করা।
গুমের মতো ঘটনা প্রতিরোধে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছেও তিনটি দাবি জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। সেগুলো হলো: গুমের অভিযোগগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করা; নিখোঁজদের খুঁজে বের করা এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন ২০০৯-এ এ ক্ষেত্রে কোনো আইনি বাধা থাকলে তা দ্রুততার সঙ্গে দূর করতে সরকারের সঙ্গে জোর যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়া, ভুক্তভোগী বা তাঁদের পরিবারকে আইনি ও নৈতিক সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে উত্থাপিত অভিযোগ নিয়ে একটি জাতীয় শুনানির আয়োজন করা।
বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে আসক জানিয়েছে, ২০০৭ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশে মোট ৬১৪ জন গুমের শিকার হয়েছেন বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন। এঁদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ৯৪ জনকে। ফেরত এসেছেন ৫৭ জন। অন্যদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায়নি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতিসংঘ ২০১০ সালে গুম থেকে সুরক্ষার উদ্দেশ্যে গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধানসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ অনুমোদন করে। এ সনদে বিস্তৃত এবং সুশৃঙ্খল উপায়ে সংগঠিত বলপূর্বক অন্তর্ধানকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে সচেতনতা আর সংবেদনশীলতা তৈরির লক্ষ্যে জাতিসংঘ থেকে প্রতিবছর ৩০ আগস্টকে বলপূর্বক অন্তর্ধানের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে পালন করার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ সনদে গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধান বলতে সরকারি বাহিনী, ব্যক্তি সমষ্টি অথবা কোনো দল কর্তৃক সরকারের কর্তৃত্বে, সহায়তা বা প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, আটক, অপহরণ বা অন্য কোনো উপায়ে ব্যক্তিকে তাঁর স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা, অন্তর্ধানের শিকার ব্যক্তির চলাফেরার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করার ঘটনাকে প্রত্যাখ্যান করা, ব্যক্তির অবস্থা অথবা অবস্থান গোপন করা এবং এর মাধ্যমে ব্যক্তিকে আইনের আশ্রয় লাভ থেকে বঞ্চিত করা বোঝায়।
এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বারবার বলপূর্বক অন্তর্ধান বা গুমের ঘটনা অস্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দেশের আইন কাঠামোতে ‘গুম’ বা ‘ইনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ বলে কোনো টার্ম নেই।
অথচ পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, সাংবাদিক বা মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুসন্ধানে গুমের সুস্পষ্ট অভিযোগ উঠে এসেছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে তুলে নেওয়ার কিছুদিন পর গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলেও গণমাধ্যমে সংবাদ বেরিয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আসক আরও বলছে, ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির ৬৭তম অধিবেশনে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তিবিরোধী সনদের আওতায় বাংলাদেশের অগ্রগতি পর্যালোচনা হয়। এ পর্যালোচনায় অঘোষিত আটক, যাকে কমিটি অন্তর্ধান বা গুম হিসেবে বর্ণনা করেছে সেই বিষয়টিতে কমিটি বলেছে, এভাবে আটককৃত ব্যক্তিকে যদি হত্যা করা হয় অথবা তিনি ফিরে আসেন—যা-ই ঘটুক না কেন, তাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে গুম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কমিটি তাদের চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণে সব আটক ও আটকাবস্থায় মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে অভিযুক্ত বাহিনীর বাইরে একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থা দ্বারা দ্রুততার সঙ্গে পরিপূর্ণ তদন্ত করা ও গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনের মাধ্যমে গুমকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সনদটি স্বাক্ষর করার সুপারিশ করেছে।
এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদন
এখনো গুম হয়ে আছেন ৮৬ বাংলাদেশি
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বাংলাদেশে এখনো ৮৬ জন গুম হয়ে আছেন। সোমবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে এইচআরডব্লিউ বলেছে, তারা মনে করে, জাতিসংঘের উচিত গুম নিয়ে একটি স্বাধীন তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া। প্রতিবেদনে গুমের জন্য বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে দায়ী করা হয়েছে।
জুলাই ২০২০ থেকে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত মোট ১১৫টি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এইচআরডব্লিউ ‘নো সান ক্যান এন্টার: আ ডিকেড অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। এটি প্রকাশিত হয় ১৬ আগস্ট। নিরাপত্তা বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা, গুম বন্ধ করা ও ভবিষ্যতে নির্যাতন প্রতিরোধের নিশ্চয়তা আদায়ে জাতিসংঘ, দাতাগোষ্ঠী ও ব্যবসায়িক অংশীদারদের উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করে মানবাধিকার সংগঠনটি।
এইচআরডব্লিউর ৫৭ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ধারাবাহিকভাবে গুম করে আসছে এবং এর বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য–প্রমাণ আছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে উন্নয়ন সহযোগিতা দিয়ে থাকে এমন দেশের সরকার, জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংগঠন ও সুশীল সমাজ বিচারহীনতার সংস্কৃতি বন্ধে আহ্বান জানিয়ে আসছে। কিন্তু সরকার কখনোই এ আহ্বানে সাড়া দেয়নি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া মহাদেশের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ ভুক্তভোগীদের উপহাস করেন এবং নিয়মিত তদন্তে বাধা সৃষ্টি করে থাকেন। এর অর্থ নিরাপত্তা বাহিনী যে গুমের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে, সেটিকে বন্ধ করতে অর্থপূর্ণ কোনো কাজ করার ইচ্ছা নেই সরকারের।’
তিনি আরও বলেন, সরকারের সমালোচনা করলেই গুমের শিকার হতে হবে, এ ভয় নিয়ে বাঁচতে হয় সমালোচকদের। যাঁরা গুম হয়েছেন, তাঁদের ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা ক্ষীণ। সে কারণে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের উচিত বাংলাদেশে গুম নিয়ে তদন্ত শুরু করা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো বহু বছর ধরেই নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। বিগত সরকারের আমলেও এমনটি ঘটেছে। কিন্তু গত এক দশকে ‘গুম’ এই সরকারের ‘হলমার্ক’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ গুম বা গুমের ভয় দেখানোর কাজটি করছে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতে এবং বাক্স্বাধীনতা হরণ করতে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে ২০০৯ সাল থেকে ৬০০ মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ পরে ফিরে এসেছেন। আবার কাউকে কাউকে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। কেউ কেউ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকার ধারাবাহিকভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বলছে, তারা মামলা করতে গেলে পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী ফিরিয়ে দিচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো গুমের বেশির ভাগ ঘটনায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) দায়ী করেছে। র্যাবকে ‘ডেথ স্কোয়াড’ হিসেবে উল্লেখ করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং বিভিন্ন সময় একে ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। সংগঠনটি আরও বলেছে, র্যাবকে শান্তিরক্ষী মিশনে যোগ দেওয়া থেকে বিরত রাখা উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে নির্যাতন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী এমন অধিনায়কদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত বছরের অক্টোবরে ১০ জন মার্কিন সিনেটর র্যাবের শীর্ষ ১০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য চিঠি দেন। এইচআরডব্লিউ বলছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্য সরকারগুলোরও উচিত হবে গুম ও মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া।