সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের পর আওয়ামী লীগের কিছু সিনিয়র নেতার ভূমিকা নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে চলছে তোলপাড়। ওই হত্যাকা-ে ওইসব সিনিয়র নেতাদের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন খোদ ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই। তাদের ভাষ্য, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সিনিয়র নেতাদের নিষ্ক্রিয়তার নেপথ্যে কোনো ষড়যন্ত্র ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা উচিত। তারা বলছেন, কেউ যদি চাপে পড়ে নীরব থেকে থাকেন তাও সঠিক তদন্তের মাধ্যমে পরিষ্কার হওয়া দরকার। তা না হলে ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগকে বারবার বিব্রত অবস্থায় পড়তে হবে।
ইতিহাসের এ নৃশংসতম হত্যাকা-ের বিষয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে অতীতেও আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তবে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে কেউ প্রকাশ্যে বক্তব্য দেননি। গেল বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজিত শোক দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ করে বক্তব্য দেন। প্রধানমন্ত্রী তার পরিবারের নিষ্ঠুর হত্যাকা-ের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রায়ই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। স্বজন হারানো বেদনায় দগ্ধ একজন শেখ হাসিনা সোনার বাংলাদেশ গড়ার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে সামাল দিতে হয় অনেক কিছু। এত কিছুর ভিড়েও মা-বাবা ও ভাইসহ স্বজন হারানোর কথা বলতে গিয়ে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজিত শোক দিবসের অনুষ্ঠানে দেওয়া এবারের বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও ইঙ্গিতময় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এবারের শোক দিবসের আলোচনাসভায় ওই সময়কার বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। তার বক্তব্য থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের শিক্ষা নিতে হবে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জানেন তাকে কতটা বৈরী পরিবেশের মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। তিনি যা বলেছেন তা তার অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া বক্তব্য।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যকা-ের বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার তার বক্তব্যের একপর্যায়ে বলেছিলেন, ‘‘…যখনই আক্রমণ শুরু হয় প্রথমে যেমন সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায় বা শেখ মনির বাসায়, খবরটা আসার সাথে সাথে এবং আমাদের বাসায় যখন গুলি শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু কিন্তু সবাইকে ফোন করেছিলেন। আবদুর রাজ্জাকের সাথে কথা হয়, তোফায়েল আহমেদের সাথে কথা হয়, সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর সাথে কথা হয়, সেনাবাহিনীরও, যার যা ভূমিকা ছিল তারাও কিন্তু সঠিকভাবে করে নাই। এর পেছনে রহস্যটা কী সেটাই কথা।’’
দলীয়প্রধানের এমন বক্তব্যের পর দলের নেতাদের অনেকেই নড়েচড়ে বসলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের বিচারের ইস্যুটাকে আরও জোরদার করার জন্য বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। কথা বলছেন দলের ভেতরেও। তাদের দাবি, একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করে আওয়ামী লীগকে দায়মুক্ত করতে হবে।
শনিবার বিকালে ডেমরা থানা আওয়ামী লীগ আয়োজিত শোক দিবসের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে প্রতিরোধ বা প্রতিবাদে ডাক আসেনি। আর প্রতিবাদের ডাক আসেনি বলে সেই সময় খুনিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের আরেক সভাপতিম-লীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘মোশতাক আওয়ামী লীগেরই ছিল। যারা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় গেছে তারাও এই দলেরই ছিল। এর বাইরে আওয়ামী লীগের কেউ যুক্ত থাকলে তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে জনসম্মুখে তাদের মুখোশ উন্মোচন এখন সময়ের দাবি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর দুই সদস্য বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত এবং যারা জীবিত অনেকের বিচার হয়েছে। অনেকে বিরুদ্ধে রায় হয়েছে। যারা বিদেশে পলাতক আছে তাদের ফিরিয়ে আনার জোর দাবি জানাই। একই সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারী মুখোশ উন্মোচনের দাবি জানাই। জাতির পিতার হত্যাকা-ে আওয়ামী লীগের কেউ জড়িত থাকলে তাদের নাম প্রকাশে কোনো প্রকার কার্পণ্য করা ঠিক হবে না। দলকে দায়মুক্ত করতে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে তাদের নাম প্রকাশ করতে হবে।’
আওয়ামী লীগের আরেক সভাপতিম-লীর সদস্য বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যা এবং এর পরিণতি বুঝে অন্য দলের নেতারাও প্রতিবাদে মাঠে নেমেছেন। তারা বিভিন্ন ধরনের প্রকাশনা করে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিনি। যারা প্রতিরোধে নেমেছিলেন তারাও এখনো খেয়ে না খেয়ে, রোগে-শোকে অবহেলায় দিন পার করছেন। এখনো অনেক প্রতিরোধযোদ্ধার ললাটে দুষ্কৃতকারীর কলঙ্ক। তখন বড় নেতারা চুপ থাকলেও তৃণমূলের কিছু নেতা প্রতিবাদ করেছে। এমনকি ২০০ প্রতিরোধযোদ্ধাকে জীবনও দিতে হয়েছে।
এর কারণ কী? এটিও একটা রহস্য। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কোনো প্রতিরোধ হয়নি সেটি আরও বড় রহস্য। এসব রহস্য উন্মোচন হলে আগামী প্রজন্ম অনেক কিছুই জানতে পারবে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের এ নেতা।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দীন নাছিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল। চাইলেই ওইদিন প্রতিরোধ গড়ে তোলা যেত। কিন্তু কেন করা গেল না? কেন জাতির জনকের লাশের দাফন-কাফন পর্যন্ত করা গেল না? দলের সবাই কি আবদ্ধ ছিল? এসব প্রশ্ন দেশের মানুষের। মানুষের মনের এ প্রশ্নগুলোই আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী সেদিন উচ্চারণ করেছেন। নাছিম বলেন, ওই সময় কেন দলের সিনিয়র নেতারা নীরব ছিলেন। তারা কি নিরুপায় ছিলেন নাকি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তা দেশের রাজনীতির স্বার্থে, আওয়ামী লীগের রাজনীতির স্বার্থে পরিষ্কার হওয়া দরকার।’
বঙ্গবন্ধু হত্যার রহস্য উন্মোচনে হতে যাচ্ছে তদন্ত কমিশন। তবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি এমন তথ্য আগস্ট মাসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একাধিকবার বলেছেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে কমিশনের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। কেমন হবে কমিশন এ প্রশ্নে আইনমন্ত্রী একটি নিরপেক্ষ কমিশন হতে যাচ্ছে এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। শনিবার সন্ধ্যায় কমিশন বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আমাদের সময়কে বলেন, কমিশনের বিষয়ে এর আগে আমি যা বলেছি তা-ই আছে। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ে আওয়ামী লীগের নিষ্ক্রিয় কয়েকজন নেতাদের নাম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এ হত্যায় আওয়ামী লীগের কেউ জড়িত হলে তদন্ত কমিশন তাদের ছাড় দেবে কিনা জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।