তালেবানের হাতে চার কোটি মানুষকে রেখে দেশ ছেড়েছেন আশরাফ গনি। কিন্তু সেই সুযোগ হয়নি আফগানিস্তানের আর এক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ নাজিবুল্লাহর। ঠিক তিন দশক আগে যখন কাবুল ঘিরে ধরেছিল মুজাহিদিন, সেই সময় প্রাণ বাঁচাতে দেশত্যাগের পরিকল্পনা করেছিলেন নাজিবুল্লাহও। কিন্তু যাদের ওপর বিশ্বাস করে জীবন বাজি রেখেছিলেন, তারাই বিশ্বাসঘাতকতা করে তার সঙ্গে। শেষে সুসজ্জিত প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে বিদ্যুতের খুঁটিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তার ক্ষতবিক্ষত দেহ।
১৯৪৭ সালে পাকতিয়া প্রদেশের গারদেজ শহরে পাশতুন পরিবারে জন্ম নাজিবুল্লাহর। ছাত্রজীবনে জম্মু-কাশ্মীরের বারামুল্লার সেন্ট জোসেফ স্কুলেও বেশ কয়েক বছর কাটে তার। মেধাবী নাজিবুল্লাহ পরে কাবুলে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে কাবুল ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। সেই সময়ই আফগানিস্তানের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সেজন্য ছাত্রাবস্থাতেই দু’বার জেলও খাটেন নাজিবুল্লাহ।
পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তান (পিডিপিএ)-এর হাত ধরে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় নাজিবুল্লাহর। ১৯৭৮ সালে পিডিপিএ আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করলে, সরকারেও ঠাঁই পান নাজিবুল্লাহ। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দেয় তার। দলের ছত্রছায়াতেই আলাদা শাখাও গঠন করেন তিনি। কিন্তু ইরানে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাকে। তারপর ইউরোপে নির্বাসনে চলে যান নাজিবুল্লাহ। ১৯৭৯ সালে সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলে প্রত্যাবর্তন ঘটে তার।
সাবেক সোভিয়েত জামানায় আফগানিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা খাদানত-ই-এতলা’ত দৌলতি-এর প্রধান নিযুক্ত হন নাজিবুল্লাহ, যার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে। সেই সময় মার্কসবাদী এবং আফগান জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেন নাজিবুল্লাহ। ১৯৮৭ সালে তাকে আফগান মসনদে বসায় রাশিয়া। কিন্তু তাদের ওপর নির্ভর করে যে সরকার চালানো যাবে না, তা বুঝে যান নাজিবুল্লাহ। তাই ক্ষমতায় এসেই দেশকে কমিউনিস্ট পূর্ববর্তী ‘রিপাবলিক অব আফগানিস্তান’ নাম ফিরিয়ে দেন। ইসলামকে প্রধান ধর্ম ঘোষণা করেন।
শুরুতে মুজাহিদিনকে পাশে পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন নাজিবুল্লাহ। কিন্তু রাশিয়া এবং তাদের সমর্থিত প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহকে উৎখাত করতে ১৯৯২ সালে কাবুল দখল করে মুজাহিদিন। সেই সময় কাবুল থেকে নাজিবুল্লাহকে উদ্ধার করার চেষ্টা চালায় ভারত। তার জন্য আফগানিস্তানে তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে তুলে গোপনে নাজিবুল্লাহকে দিল্লি নিয়ে আসার পরিকল্পনা ছিল দিল্লির। সেই মতো গাড়িতে উঠেও পড়েন নাজিবুল্লাহ। কিন্তু আফগান সেনাবাহিনীর মার্শাল, ‘যুদ্ধবাজ’ হিসেবে পরিচিত যে আবদুল রশিদ দোস্তুমকে বিশ্বাস করেছিলেন নাজিবুল্লাহ, শেষ মুহূর্তে বিশ্বাসঘাতকতা করেন তিনি।
শোনা যায়, দোস্তুমকে টাকা জোগাতেন নাজিবুল্লাহ। কিন্তু ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েতের বিভাজনের পরে ভাঁড়ার খালি হয়ে আসে তার। ওদিকে টাকার জোগান আটকে যাওয়ায় মুজাহিদিনের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ শুরু করে দেন দোস্তুম। যে কারণে বিমানে চেপে ভারতে পালিয়ে আসার পরিকল্পনা থাকলেও বিমানবন্দরে ঢোকার মুখে তার গাড়ি আটকে দেন দোস্তুমের নিয়ন্ত্রণে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা। বিমানবন্দরের রানওয়ে-তে তখন বিমান দাঁড়িয়ে। ভিতরে ভারত সরকারের প্রতিনিধি এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল তার জন্য অপেক্ষা করছেন।
কিন্তু বিমানবন্দরে ঢুকতেই পারেননি নাজিবুল্লাহ। আবার প্রেসিডেন্ট ভবনেও ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না, কারণ সেটি তখন মুজাহিদিনের দখলে। অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে কাবুলে জাতিসংঘের একটি কার্যালয়ে ঢুকে পড়েন তিনি। সেখানেই পরবর্তী সাড়ে চার বছর স্বেচ্ছায় নির্বাসন কাটান তিনি। আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ এবং পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর মদতে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে মুজাহিদিনকে হারিয়ে কাবুলের দখল নেয় তালেবান। তাতে জাতিসংঘের দফতরে আশ্রয় নেওয়া নাজিবুল্লাহ, তার ভাই এবং তাদের দুই সহযোগী নতুন করে বিপাকে পড়েন।
সেই সময় মুজাহিদিন নেতা তথা তৎকালীন আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আহমদ শাহ মাসুদ এগিয়ে আসেন। নাজিবুল্লাহ এবং তার সঙ্গীদের উত্তর দিক থেকে নিরাপদে করিডোর তৈরি করে বের করে নিয়ে যেতে উদ্যোগী হন তিনি। কিন্তু তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন নাজিবুল্লাহ। তার যুক্তি ছিল, পাশতুনরা তালেবানের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমন সময় পাশতুনদের সঙ্গে আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক যে তাজিক গোষ্ঠীর, তার সদস্য মাসুদের সাহায্য নিলে পরিস্থিতি অন্যদিকে মোড় নিতে পারে।
তাই নাজিবুল্লাহ, তার ভাইকে ফেলেই সরে পড়ে মুজাহিদিন। দফতর খালি করে দেন জাতিসংঘের কর্মকর্তারাও। এরপরই ওই দফতরের দখল নেয় তালেবান। কূটনীতিবিদদের দাবি, তালেবান যোদ্ধারা যখন ওই দফতরে ঢুকছেন, সেই সময় এক আইএসআই কর্মকর্তাও সেখানে নাজিবুল্লাহর ভাগ্য নির্ধারণে যোগ দেন। কারণ মুজাহিদিনের সঙ্গে মিলে তার সরকার ফেলতে পাকিস্তানের বড় ভূমিকা ছিল বলে বরাবরই অভিযোগ তুলে এসেছিলেন নাজিবুল্লাহ।
এরপরই, ২৭ সেপ্টেম্বর সকালে কাবুলে প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে বিদ্যুতের খুঁটিতে বাঁধা অবস্থায় নাজিবুল্লাহর ক্ষতবিক্ষত দেহ ঝুলতে দেখা যায়। শোনা যায়, নাজিবুল্লাহ এবং তার ভাইকে বেধড়ক মারধর করা হয়। জিপের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে ঘোরানো হয় শহরে। তার পর প্রথমে লিঙ্গচ্ছেদ করা হয় তাদের। শেষে গুলি করে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
নাজিবুল্লাহর হত্যার মাধ্যমেই সেই প্রথম তালেবান নৃশংসতার সাক্ষী হয় গোটা বিশ্ব। এমনকি সৌদি আরব, যারা কি না তালেবানের মিত্র বলে পরিচিত, তারাও নাজিবুল্লাহ হত্যার তীব্র নিন্দা করে। তালেবানের আচরণ ইসলামবিরোধী বলেও মন্তব্য করে তারা।
২০১৬ সালে নাজিবুল্লাহর ২০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সরাসরি তার মৃত্যুর জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে আফগান রিসার্চ সেন্টার। পাকিস্তানই আসলে নাজিবুল্লাহকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে বলে অভিযোগ তোলেন তারা। ২০২০ সলের ১ জুন গারদেজ-এ নাজিবুল্লাহর সমাধিস্থলে গিয়ে প্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে শ্রদ্ধা জানান আফগানিস্তানের সদ্য প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হামিদুল্লাহ মোহিব। নাজিবুল্লাহর নামে সৌধ গড়ার প্রস্তাব দেন তিনি।
কিন্তু নাজিবুল্লাহর স্ত্রী ফাতানা নাজিব ও পরিবারের লোকজন সাফ জানিয়ে দেন, আগে নাজিবুল্লাহর হত্যার তদন্ত করুক সরকার। দোষীদের খুঁজে বের করুক। তারপর সৌধ নির্মাণ হবে। তার এক বছর কাটার আগেই তালেবানের পুনরুত্থান শুরু হয়ে যায় আফগানিস্তানে। আশরাফ গনির মতো হামিদুল্লাহ নিজেও আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়েছেন। সূত্র: আনন্দবাজার