করোনা সংক্রমণ বিস্তার রোধে জনসাধারণের চলাচলের ওপর সরকারের দেয়া বিধিনিষেধের মেয়াদ শেষ হয়েছে গতকাল। আজ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিনোদনকেন্দ্র ছাড়া সবকিছুই চালু হচ্ছে। করোনার উচ্চ সংক্রমণ ও সর্বোচ্চ মৃত্যুর খবরের মধ্যেই জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক হতে যাচ্ছে। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখা ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিধিনিষেধ শর্তসাপেক্ষে শিথিল করা হয়েছে। তবে প্রয়োজন হলে ফের বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় না এনে বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের কারণে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, একদিকে দেশের বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থায় দীর্ঘ সময় বিধিনিষেধ বা লকডাউন পালন সম্ভব না। লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকার যে প্রণোদনা দেয় তাও চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল।
অনেক ক্ষেত্রে সেই প্রণোদনাও সঠিকভাবে পৌঁছায় না। অন্যদিকে লকডাউন খুলে দিলে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে মানুষের মাঝে অনীহা দেখা যায়। মানুষ সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করে না। গণপরিবহন ও শপিংমলগুলোতে সামাজিক দূরত্ব মানা হয় না। আর সংক্রমণ বেড়ে গেলে হাসপাতালগুলোর সেবা দেয়ার সক্ষমতা থাকে না। অক্সিজেনের সংকট দেখা দেয়। মৃত্যুহার বাড়ার পেছনে স্বাস্থ্য খাতের এ অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বেশির ভাগ মানুষকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা গেলে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসতো বলে মনে করছেন তারা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেছেন, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা এবং সঠিকভাবে সকলকে মাস্ক পরিধান করানো গেলে আমরা এ যাত্রায় হয়তো উতরে যেতে পারি।
ওদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আজ থেকে সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল করবে। আগে লকডাউন শেষে অর্ধেক আসনে পরিবহন চালু করা হলেও এবার পূর্ণ আসনে যাত্রী নিয়ে সব যানবাহন চলাচল করবে। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে যাত্রীরা পূর্ণ আসনে গেলেও বাস চালানো হবে অর্ধেক। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সরকারি এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। তারা বলছেন, এতে সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়বে। যদিও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ বলছে, আসনের বাইরে যানবাহনে মানুষ যাতায়াত করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মঙ্গলবার দেশে ফের করোনাভাইরাসে মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে। একদিনে আরও ২৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মৃতের মোট সংখ্যা ২৩ হাজার ছাড়িয়েছিল। এর আগে গত ৫ই আগস্ট ২৬৪ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দেশে একদিনে কোভিডে মৃত্যুর এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা। রেকর্ড মৃত্যুর পরদিন ৬ই আগস্ট দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর মোট সংখ্যা ২২ হাজার পেরিয়ে গিয়েছিল। তা ২৩ হাজারে পৌঁছালো মাত্র চার দিনে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মঙ্গলবারের ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে সাড়ে ৪৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা করে আরও ১১ হাজার ১৬৪ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তাতে এ পর্যন্ত শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৩ লাখ ৭৬ হাজার ৩২২ জন। আর শনাক্তের হার ছিল ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। অর্থাৎ, ১০০ জন সন্দেহভাজন রোগী করোনা টেস্ট করালে তাদের মধ্যে ২৪ জনেরই ফল পজেটিভ আসছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে গত মাসের প্রথম দুই সপ্তাহ দেশে সর্বাত্মক বিধিনিষেধ পালন করা হয়। এ সময় সব ধরনের অফিসের পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচলও বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু ২১শে জুলাই ঈদুল আজহা উপলক্ষে এই বিধিনিষেধ আটদিনের জন্য শিথিল করা হয়। ঈদের পর ২৩শে জুলাই থেকে আবার সর্বাত্মক বিধিনিষেধ চালু করা হয়। যা গতকাল শেষ হয়েছে। আজ থেকে অফিস, ব্যাংক, রেস্তরাঁ, দোকানপাট ও গণপরিবহনসহ প্রায় সব কিছু খুলে দেয়া হলো। মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে এতদিন বাস-ট্রেন-লঞ্চে অর্ধেক আসন ফাঁকা রেখে যাত্রী পরিবহন করতে দেয়া হয়েছিল। তবে এবার আর সেই বিধিনিষেধ থাকছে না।
মানুষের জীবন ও জীবিকার স্বার্থে সরকার লকডাউন শিথিল করলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় আবারো কঠোর লকডাউন দেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আর তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে লাগাতার বিধিনিষেধ দিয়ে রাখা সমাধান নয়। এটি খেটে খাওয়া মানুষের দেশ। এখানে জীবন-জীবিকার মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। জীবিকা সচল রাখতে বিধিনিষেধ শিথিল হচ্ছে।