সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মডেল, অভিনেত্রী, প্রযোজকসহ বেশ কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য ও অভিযানের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞদের।
বাংলাদেশে বিনোদন জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকজনের বাসায় সাম্প্রতিক সময়ে অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাড়ি থেকে মাদক উদ্ধার, বাসায় পার্টি করাসহ বেশ কিছু অভিযোগ তুলে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার মধ্যে গত জুনে এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করা জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা পরীমণিও রয়েছেন।
গত কয়েক দিনের এসব অভিযান, পুলিশের সরবরাহ করা তথ্য ও বক্তব্য মূল ধারার গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিস্তর আলোচনার জন্ম দিয়েছে৷
হঠাৎ বিনোদন জগত সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন তৎপরতার তিনটি কারণ দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। সেগুলো হলো- এক, যারা ক্ষমতাশালী মহল আছে, যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এরা এসব করে, তাদের কোনো কোনো পক্ষের মধ্যে বিরোধ হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাবান কেউ হয়তো ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন, তিনি আবার প্রকাশ্যে আসতে চান না। তার মুখের অভিযোগের ভিত্তিতে এই অভিযান হতে পারে। আর তৃতীয়ত, অনেকই যেটা মনে করেন, করোনাতে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে নিতে এটা করা হচ্ছে৷ বাস্তবিক অর্থেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার চেতনা থেকে এই অভিযানগুলো করা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে আমার প্রচণ্ড সন্দেহ আছে৷
এর আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাও করেছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-১৯ সালে চালানো এসব অভিযানে ‘৪৬৬ জন বিচারবহির্ভূত’ হত্যার শিকার হয়েছিলেন৷ এ নিয়ে তখন দেশ-বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। প্রভাবশালী বা গডফাদার হিসেবে পরিচিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় মাদক দূর করতে সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আমার যেটা মনে হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যদি সত্যি সত্যি সদিচ্ছা থাকে মদ-মাদকমুক্ত একটা সমাজ তৈরি করবে তাহলে রাঘববোয়ালদের ধরা হচ্ছে না কেন? এখানে তো কোন নিম্নবিত্ত না, মধ্যবিত্তও যাওয়ার সুযোগ পায় না। কারা সেখানে যায়, যাদের অবৈধ অঢেল টাকা আছে। দুর্নীতি করে যারা টাকা কামিয়েছে বা এই ধরনের খারাপ কাজের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক আছে। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের কাছ থেকে নামগুলো তো পাওয়া গেছে, কারা তাদের কাছে যায়। তাহলে তাদের কেন ধরে আনা হচ্ছে না?
গ্রেফতারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া বিশেষণ
মডেল, অভিনেত্রীদের গ্রেফতারের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের নামের আগে-পরে বিভিন্ন পদবি-উপাধি বা বিশেষণ জুড়ে দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে। এমনকি দুজন মডেলকে গ্রেফতারের পর তাদেরকে ‘রাতের রানি’ হিসেবে উল্লেখ করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ বক্তব্য দিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে ৷ আইন বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মী ও পুলিশের সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের অনেকেই এর সমালোচনা করছেন৷
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘কাউকে গ্রেফতারের পর নামের আগে-পরে কোন পদবি বা উপাধি ব্যবহার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী করতে পারে না৷ পাশাপাশি সম্প্রতি যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত বিচারে তারাই সুবিধা পাবে৷ এই ধরনের মিডিয়া ট্রায়াল সব সময় আসামিদের পক্ষে যায়৷
পৃষ্টপোষকদের নাম কখনো জানা যাবে না উল্লেখ করে অধ্যাপক আসিফ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘তারা যদি কোনো সুনির্দিষ্ট অপরাধ করে থাকে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগটা মিডিয়াকে জানাতে পারে৷ রাতের রানি হিসেবে অভিহিত করা এবং স্টেটমেন্ট আকারে বলা ওরা এই এই করেছে৷ অভিযোগ আকারে না, রায়ের মতো করে বলে দেয়া হচ্ছে৷ এটা পুলিশ, পত্রিকা বা সামাজিক গণমাধ্যম কেউ করতে পারে না৷
দ্বিতীয়ত, পুলিশ বলছে, রাতের রানি৷ তাহলে তো রাতের রাজাও থাকবে৷ রাজারা কোথায়, তারা গ্রেফতার হচ্ছে না কেন? আর পুলিশ যে বলছে, ব্লাকমেইলিংয়ের অভিযোগ আছে৷ তো অভিযোগটা কে দিয়েছে? এটা তো আমরা জানতে চাই? মুখের কথায় অভিযোগ শুনে পুলিশ গ্রেফতার করতে যাবে, দেশ তো এখন ওই জায়গায় নেই৷ লিখিত অভিযোগ কেউ দিয়েছে? দিয়ে থাকলে পুলিশকে সেটা জানাতে হবে৷
তৃতীয়ত, মদ বা মাদক যদি পরীমণির বাসায় পাওয়া যায়, এই মদ তো হেঁটে হেঁটে তার বাসায় আসেনি৷ এটা নিশ্চয় কোথাও থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে৷ তাহলে মদ বিতরণ কেন্দ্র বা সংগ্রহ কেন্দ্রের সাথে কারা জড়িত আমরা কখনই সেটা জানতে পারি না৷ আমার আশঙ্কা পরীমণি বা পিয়াসার ঘটনায় যারা পৃষ্ঠপোষক, বেনিফিশিয়ারি, যারা রাতের রাজা তাদের পরিচয় আমরা জানতে পারব না৷’
সূত্র : ডয়চে ভেলে