রানীরা জেলে, রাজারা আড়ালে

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


সৈয়দ বোরহান কবীর

বিশ্বে যখন করোনার প্রকোপ শুরু হলো তখন আমার মনে হয়েছিল মানুষের আত্মোপলব্ধি হবে। রুদ্ধশ্বাস ছুটে চলা, অন্তহীন লোভ আর বেপরোয়া জীবনের লাগাম টেনে ধরবে। মানুষ ফিরে তাকাবে। প্রকৃতি, সমাজ এবং নিজের প্রতি মানুষ যে অন্যায়, অবিচার করেছে তা কিছুটা হলেও কমবে। আমার মতো অনেকেই আশা করেছিল পৃথিবীর অস্থিরতা, অসুস্থ মানসিকতা, স্বেচ্ছাচারিতা কমবে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। করোনার দেড় বছরে মানুষ যেন আরও স্বার্থপর হয়ে উঠছে। আরও পচন ধরছে সমাজে। বাংলাদেশে গত কয়েক দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যা উন্মোচন করছে তাতে মনে হচ্ছে, মানুষ যেন আরও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠছে। এখন বাংলাদেশে করোনায় প্রতিদিন মারা যাচ্ছে দুই শর ওপর। আক্রান্তের হার ৩০ শতাংশের আশপাশে। কিন্তু এসবকে পাত্তাই দিচ্ছেন না হেলেনা, পিয়াসা, মৌ, পরীমণিরা। এ নামগুলো শুনে মনে হতেই পারে নারীরাই বোধহয় এখন সব অপকর্মের হোতা। পুরুষরা যেন ঘরে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলে তাই? বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী’ কবিতায় নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলেছেন। কবি নজরুল কেবল ভালো কাজে নারী ও পুরুষের সমান অবদানের কথা বলেননি, খারাপ কাজেও বলেছেন- ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণ কর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর/বিশ্বে যা কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রু বারি/অর্ধেক তার আনিয়াছে নর অর্ধেক তার নারী।’ অর্থাৎ পৃথিবীতে কল্যাণ যেমন নারী ও পুরুষের যৌথ অবদান তেমনি পাপেরও সমান ভাগিদার নারী ও পুরুষ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে হেলেনা, পিয়াসা, মৌ, পরীমণিকে নিয়ে যে তোলপাড় তা অনেক ক্ষেত্রেই শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে এক ধরনের আদিম বিকৃতির উল্লাসও দেখা যাচ্ছে। অপরাধ করলে তো আইনের আওতায় আসতেই হবে। তথাকথিত রানীরাও আইনের আওতায় আসছেন। তাদের সম্পর্কে যেসব তথ্য বেরোচ্ছে তা পিলে চমকানোর মতো। কিন্তু আমার প্রশ্ন, এসব নারী একাই কি এ ধরনের অপরাধ করেছেন? নাকি এর পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী ‘রাজা’রা। আমরা দৃশ্যপটে রানীদের দেখছি। রাজারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাবলিতে রাজনীতি, অপরাধ এবং যৌনতার এক ককটেল হয়েছে। হেলেনা জাহাঙ্গীর রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যায়-অনিয়ম করেছেন। তার যেসব অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেরিয়েছে তা ঔদ্ধত্যপূর্ণ। হেলেনা জাহাঙ্গীর রাজনীতির মাঠে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কীভাবে? আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দলে তিনি কারও মদদ এবং পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই উপকমিটিতে ঢুকে পড়বেন তা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকিও এ নিয়ে লুকোচুরি করেননি। তিনি বলেছেন তার জেলার নেতা, সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীর অনুরোধে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে মহিলাবিষয়ক উপকমিটিতে নেওয়া হয়েছে। কান পাতলেই শোনা যায়, ওই মন্ত্রী নাকি হেলেনার ভুয়া টেলিভিশন জয়যাত্রার অংশীদারও। সরকারের অন্যতম জ্যেষ্ঠ এই মন্ত্রী জাতির কাছে এখন এক কৌতুকের নাম। তাকে আমরা ‘থুক্কু মন্ত্রী’ও বলতে পারি। মানুষ যেমন ভুল করে থুক্কু বলে, এই মন্ত্রীও তেমনি। একবার রাজাকারের তালিকা করলেন। তারপর নিজেই বললেন, ‘আমি বেআক্কেলের মতো কাজ করেছি’। এই সেদিন সারা দেশে আতঙ্ক এবং ক্ষোভ ছড়িয়ে দিলেন শব্দবোমা ফাটিয়ে। Bangladesh Pratidinটেলিভিশনে মন্ত্রীর লাইভ হুমকি শুনে দেশের মানুষ হতভম্ব হয়ে গেল- ‘১১ আগস্ট থেকে ১৮ বছরের বেশি বয়সী কেউ টিকা ছাড়া ঘর থেকে বেরোলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।’ কি সাংঘাতিক! যেন বাংলাদেশে কোটি কোটি ডোজ টিকা মজুদ আছে। লোকজনের টিকার আগ্রহ নেই। এজন্যই এ হুমকি। পরদিন মন্ত্রী বললেন ‘থুক্কু’। সংবাদ সম্মেলনে এসে ম্লান হাসি হেসে বললেন, ‘ওই অংশটুক প্রত্যাহার করা হলো’। অবশ্য আগের দিন রাতেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হলো, ‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত নয়।’ ভালো কথা। ওই বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তো বসেই ছিলেন। কেন তিনি ওই বক্তব্য থামিয়ে দিলেন না। কেন বললেন না এটা কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী জানালেন এ রকম (টিকা ছাড়া কেউ ঘর থেকে বেরোতে পারবে না) সিদ্ধান্তই হয়নি। আমরা আমজনতা। কোনটা সত্য আমরা কী করে বুঝব। যাক সে প্রসঙ্গ। কিন্তু হেলেনাকে আওয়ামী লীগে উপহার দেওয়া সেই মন্ত্রী (রাজা) ধরাছোঁয়ার বাইরে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও তাকে কেউ আনুষ্ঠানিক প্রশ্ন করেনি। অথচ এবার আওয়ামী লীগের উপকমিটি গঠনের আগে আওয়ামী লীগের নেতাদের হুঁশিয়ার, সাবধান বহু শুনেছি। কোনো বিতর্কিত কাউকে উপকমিটিতে নেওয়া হলেই শাস্তি। তাহলে হেলেনাকে উপকমিটিতে নেওয়ার অভিযোগে কারও শাস্তি না হোক, শোকজ হয়েছে কি? রাজনীতির মাঠে বসে হেলেনা বহুমাত্রিক ঠগবাজির ফাঁদ পাতেন। নিশ্চয়ই তার গডফাদার ছিল। নেপথ্যের কারও শক্তিতেই হেলেনা যা খুশি তা-ই শুরু করেছিলেন। প্রভাবশালী কারও খুঁটি ছাড়া হেলেনা এভাবে ফুলে-ফেঁপে ওঠেন কীভাবে? হেলেনার ছবিগুলো খতিয়ে দেখলাম। হেলেনার সঙ্গে কে নেই? অনেক গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর ছবি। তিনি নাকি বিজিএমইএর নেতাও ছিলেন। এখন শুধু রানী হেলেনাই আসামি। বাকিরা সব যেন সাধু!
এক রাতে মোহাম্মদপুর ও বারিধারায় রোমাঞ্চকর অপারেশনে আটক হলেন পিয়াসা এবং মৌ। গণমাধ্যমে বলা হলো মডেল মৌ। চমকে উঠলাম। মডেল মৌ মানেই আমরা বুঝি সাদিয়া ইসলাম মৌকে। পত্রিকায় ছবি দেখে আশ্বস্ত হলাম। এ মৌ সেই মৌ নয়। এটা দেশের একজন স্বনামধন্য শিল্পীর জন্য কত বড় অপমানজনক ভাবা যায়! বাংলাদেশে এখন লুঙ্গির স্টিকারে ছবি ছাপা হলেই সে মডেল। একটা নাটকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেই অভিনয়শিল্পী। সেই সূত্রে ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা এবং মরিয়ম আক্তার মৌও মডেল। ভালো কথা। দুই রাতের রানীর বাসায় দেখলাম মদ, ইয়াবা, সিসার ভান্ডার। গণমাধ্যমে বলা হলো, এদের বাড়িতে রাতে আসর হতো, তাতে অনেক বড়লোক আসতেন। কারা আসতেন? কবি নীরব। অর্থনীতিতে মূল কথা হলো চাহিদা ও জোগানের সম্পর্ক। চাহিদা থাকলেই একটা ব্যবসা তৈরি হয়। কিছু লম্পট, বিকৃত পুরুষ যায়, এজন্যই তো পিয়াসারা এভাবে হেরেম করেছেন। একটি গণমাধ্যমে পড়লাম পিয়াসা, মৌদের টার্গেট নাকি উঠতি বড়লোকের সন্তানরা। ফুসলিয়ে তাদের এসব বাড়িতে নিয়ে আসা হতো, এরপর হাতে তুলে দেওয়া হতো মাদক, ইয়াবা ইত্যাদি নেশাজাতীয় দ্রব্য। খবরটা পড়ে মনে হলো, আমাদের বড়লোকের উঠতি বাচ্চারা যেন ফিডারে এখনো দুধ খায়। তারা বেজায় ভোলা। লেবনচুষ মুখে দিয়ে তারা ঘোরে। বড়লোকদের উঠতি বয়সের বাচ্চাদের ছেলেধরারা ধরে নিয়ে পিয়াসা, মৌদের হাতে তুলে দেয়। পিয়াসা, মৌরা তাদের ছেলে ভোলানো ছড়া শুনিয়ে ফিডারের বোতলে মদ দিয়ে দেয়। এরপর তারা মাথা ব্যথা বলে কান্নাকাটি করলে তাদের ওষুধ বলে ইয়াবা খাইয়ে দেয়। এরপর তাদের পরনের ডাইপার খুলে ফেলার মতো, তাদের বস্ত্র হরণ করে ছবি তুলে ব্ল্যাকমেল করে। পিয়াসা, মৌ বড়লোকের সন্তানদের নষ্ট করার দায়ে অভিযুক্ত। কিন্তু বড়লোকের বাচ্চারা পিয়াসাকে চেনে কীভাবে? কীভাবে তারা মক্ষীরানীদের ঘর চেনে? পিয়াসাদের রাতের অতিথি কারা? এদের নামের তালিকাটা যদি প্রকাশ হতো তাহলে জাতি উপকৃত হতো। আজ পিয়াসা মৌকে ধরা হয়েছে। ক্ষুধার্ত বড়লোকদের সন্তানরা কাল নতুন পিয়াসা, মৌ বানাবে। তা ছাড়া পিয়াসা, মৌদের কারা সৃষ্টি করল? কাদের অর্থে এরা এ রকম বিলাসবহুল জীবন যাপন করছিল। সেই গডফাদারা পর্দার আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। পিয়াসা ফেসবুকে অস্ত্রসহ ছবি দিয়েছে। অভিযোগ আছে, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায় জড়িয়েছিলেন পিয়াসা। পিয়াসার সূত্র ধরে শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান ও জিসানকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু পিয়াসা-মৌকে নিয়ে মূলধারার গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যত উন্মাদনা, ঠিক ততটাই অনাগ্রহ মিশু আর জিসানকে নিয়ে। কেন? অস্ত্র নিয়ে ফেসবুকে ছবি দেওয়া অপরাধ অবশ্যই। কিন্তু একই অপরাধে তো সবার একই ধরনের পরিণতি হওয়ার কথা। কিছুদিন আগে চট্টগ্রামের এক হুইপপুুত্রের অস্ত্রসহ ছবি দেখে আমরা আঁতকে উঠলাম। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখলাম না। চট্টগ্রামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা আত্মহত্যায় বাধ্য হলেন মানসিক অত্যাচারে। প্রয়াত ওই ব্যাংক কর্মকর্তার স্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে বিচার চাইলেন। আকুল কান্নায় তিনি হুইপপুত্রের নিপীড়নের বিবরণ দিলেন। কিন্তু কোথায় কি? এ ‘রাজা’রা যেন স্পর্শের বাইরে। এখন দেখলাম, সেই হুইপ টিকা নিয়ে এক মহাকেলেঙ্কারি করলেন। নিবন্ধন, নিয়মনীতি নির্বাসনে পাঠিয়ে ওই হুইপ যেন এক আলাদা রাজত্ব কায়েম করলেন তার নির্বাচনী এলাকায়। কে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পেরেছে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুধু মিনমিন করে বলেছে, ‘জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীল হতে হবে’। তাহলে কি একটি নির্বাচনী এলাকায় একজন এমপি ‘রাজা’? তার যা খুশি তা-ই করার লাইসেন্স আছে?

‘রানী আটক’ ধারাবাহিক নাটকের শেষ নাম পরীমণি। বুধবার (৪ আগস্ট) ছিল বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া খেলা। টি-টোয়েন্টি খেলা মানেই শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা। কিন্তু সে উত্তেজনার আগুন নিভিয়ে দিলেন পরীমণি। বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলল লাইভ সিনেমা। এর মধ্যে চুলোয় গেল মুস্তাফিজের দুর্দান্ত বোলিং, আর করোনায় আক্রান্তের হার কমার স্বস্তিকর খবর। পুরো দেশের চোখ যেন বনানীতে। পরীমণির বাসায়। কেউ কেউ টিভিতে দেখে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। ছুটে গেলেন পরীমণির বাসায়। কঠোর লকডাউনে পরীমণির বাসার সামনে হাজারখানেক লোক। আমরা প্রতিদিন বিকালে শুনি লকডাউন অমান্য করায় কতজনকে জরিমানা করা হয়েছে, কতজনকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তার পরিসংখ্যান। কিন্তু পরীমণির বাসার সামনে এ গণজমায়েতের জন্য কি কাউকে জরিমানা করা হয়েছে? পরীমণি ইস্যু অবশ্য নতুন নয়। পরীমণি যে ফেঁসে যাচ্ছেন তা ছিল নির্ধারিত। ৮ জুন বোট ক্লাবের নাটকের পর পরীমণির আটকের দিন গোনা হচ্ছিল। বুধবারও পরীমণি একই নাটক করতে চেয়েছিলেন। ফেসবুক লাইভে এসে তিনি গণমাধ্যম আর সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন। অভিনয়টাও ছিল আবেগঘন। কিন্তু পরীমণির ঘটনা আর ‘বাঘ এসেছে’ বলে রাখাল বালকের ঘটনা যেন একই রকম। বোট ক্লাবের ঘটনার পর তিনি যে নাটক করে জনগণ ও গণমাধ্যমকে বেকুব বানিয়েছেন, সেই নাটক এবার ফ্লপ হলো। কিন্তু আমার সেই একই প্রশ্ন, পরীমণির পেছনে কে? তাকে কে এত বিত্তবৈভব দিল? কে দিল বেপরোয়া, ড্যাম কেয়ার জীবনের লাইসেন্স। পরীমণিকে আটকের পরপরই অভিযান চালানো হয় পরীমণির প্রথম প্রযোজকের বাসায়। কিন্তু সেই অভিযান মিডিয়ার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়নি। মানুষও এ নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। কেন, রাজ পুরুষ বলে? তিনি যে পরীমণির গডফাদার নয় তা পরিষ্কার। রানীর রাজারা কি আসবেন পাদপ্রদীপে?

সাম্প্রতিক সময়ে মাদক, অনৈতিক কর্মকান্ড এবং ব্ল্যাকমেলিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এ রকম অভিযান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এসব ঘটনা কেবল একটি অপরাধ নয়, এসব সমাজকে পচন ধরায়। সমাজে যে পচন ধরেছে এ ঘটনাগুলো তার প্রমাণপত্রও বটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, একটি সংঘবদ্ধ চক্র এসব অপরাধ এবং অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। আমরা আশা করি সংঘবদ্ধ চক্রের সবাইকে, নেপথ্যের হোতাদেরও সামনে আনা হবে। না হলে এসব অভিযান শেষ পর্যন্ত বিকৃতির উৎসবে পরিণত হবে। আড়ালে থাকা রাজাদের যদি সামনে আনা না যায় তাহলে গডফাদার রাজারা নতুন হেলেনা বানাবে। পিয়াসা, মৌর মতো নতুন মক্ষীরানী তৈরি হতেও সময় লাগবে না।

আমার উদ্বেগের দ্বিতীয় কারণটি গভীর এবং গুরুতর। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, বিরোধীদলীয় নেতা নারী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত এক যুগে নারীর ক্ষমতায়নে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। প্লেন থেকে সচিবালয়ে, করপোরেট থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়- সবখানে নারীরা উদ্ভাসিত হয়েছেন, আলো ছড়াচ্ছেন। তার পরও নারীমুক্তির অভিযাত্রায় সাফল্যের জন্য অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। এখনো নারীরা নিগৃহীত হয় সর্বত্র। যৌন নিপীড়ন, পাশবিকতা, বৈষম্য নারীর ওপরই হয় বেশি। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই একই চিত্র। এখনো নারীকে ঘরবন্দী রাখার ষড়যন্ত্র চলে।

ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী এখনো নারীকে শুধু সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র কিংবা সম্ভোগের বস্তুই মনে করে। পশ্চিমা সংস্কৃতি নারীকে বানায় পণ্য। নারীদের অর্গলমুক্তির সংগ্রামটা এখনো শেষ হয়নি। হেলেনা, পরীমণির ঘটনা যেন মৌলবাদী, ধর্মান্ধ, নারী নিপীড়নকারীদের হাতে নতুন অস্ত্র তুলে না দেয়। আমরা লক্ষ্য করেছি, কিছু নারী নিপীড়নের ঘটনার পর বিকৃত রুচির কতিপয় মানুষ ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেছে ঘরের বাইরে যাওয়ার কারণে কিংবা পোশাকের জন্যই নাকি নারী নির্যাতনের শিকার। এ ধরনের ঘৃণিত বক্তব্য কেবল অগ্রহণযোগ্য নয়, রীতিমতো অপরাধ। পিয়াসা, মৌর ঘটনার পর কান পাতলেই কিছু নোংরা অশ্লীল কথা শুনি। ব্যক্তি নারীর অপরাধের দায় যেন গোটা নারী জাতির ওপর না আসে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। কয়েকজন বিচ্ছিন্ন বিপথগামী এবং পুরুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নারীর অপকর্মের দায় কেন সব নারীকে নিতে হবে? এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে একটি মহল কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণকে বাধা সৃষ্টির যুক্তি হিসেবে যেন ব্যবহার না করতে পারে সে ব্যাপারে অবশ্যই আমাদের সচেতন এবং দায়িত্বশীল থাকতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, নারী প্রধানমন্ত্রী হলেও দেশটা এখনো পুরুষতান্ত্রিক। পরীমণি, পিয়াসাকে উপলক্ষ করে কেউ কেউ নারীর অমর্যাদার খেলায় যেন না মাতে, বিকৃতির পাশবিক উৎসব না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে হেলেনা, পরীমণি, পিয়াসা কিংবা মৌ পুরুষদের বানানো উপভোগের বস্তু। এদের গ্রেফতার করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে না। এরা হলেন পুতুলনাচের পুতুল। সুতো যে পুরুষের হাতে, সেই পুরুষদের নিবৃত্ত না করতে পারলে তারা নতুন পুতুলে মঞ্চ সাজাবে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ইমেইল : [email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *