রাজ-পরীমনি সিন্ডিকেটে দুই ডজন প্রভাবশালী!

Slider টপ নিউজ


প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ ও নায়িকা পরীমনিকে গ্রেপ্তারের পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাতেই জানা যায়, তাদের সিন্ডিকেটে রয়েছেন অন্তত দুই ডজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। এরই মধ্যে সেই বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে র‌্যাব। রাজ-পরীমনি সিন্ডিকেটে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলেই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাহিনীটির তদন্তসংশ্লিষ্টরা। তবে র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্য রাজ ও পরীমনি দিয়েছেন, সেগুলোর সবই ঠিক, এমনটি নাও হতে পারে। এ কারণে তাদের দেওয়া সব তথ্য তদন্ত করেই সিদ্ধান্ত নিতে চায় র‌্যাব। এদিকে পরীমনি ও রাজ এবং তাদের দুই সহযোগীকে চার দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।

তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, পরীমনির বাসায় ছিল একটি মিনিবার। সেখানে নিয়মিতই পার্টি হতো। তাতে মদসহ সব ধরনের মাদকের সাপ্লাই দিতেন নজরুল ইসলাম রাজসহ কয়েকজন। এসব পার্টিতে আসতেন উচ্চবিত্তদের বখে যাওয়া তরুণ-তরুণীরা। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার রাজ-পরীমনি

সিন্ডিকেটের শিকারে পরিণত হতেন। জিম্মি করে আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের টাকা। মূলত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মনোরঞ্জনের জন্য নিয়ে আসা হতো মডেলসহ সুন্দরী তরুণীদের। গোপনে ধারণ করে রাখা হতো বিশেষ মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও। পরে সেগুলোই ব্যবহার করা হয় ব্ল্যাকমেইলের হাতিয়ার হিসেবে। রাজের নেতৃত্বে একটি টিম ছিল, যাদের কাজই হলো উঠতি বয়সী তরুণীদের দিয়ে নানারকম অপকর্ম করানো। গ্রেপ্তার রাজ ও মিশু হাসানের মোবাইল ও ল্যাপটপ ঘেঁটে অনেক প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরই বিশেষ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও মিলেছে। গোপনে ধারণ করা এসব ছবি দিয়েই চলত তাদের ব্ল্যাকমেইল।

মিশু হাসান ও জিসানকে গত মঙ্গলবার গ্রেপ্তারের পরই তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরীমনি ও রাজের বাসায় অভিযান চালানো হয়। সেখানে বিপুল পরিমাণ মাদক পাওয়ায় গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকাইয়া চলচ্চিত্রের আলোচিত নায়িকা পরীমনি ও প্রয়োজক রাজসহ চারজনকে।
উত্তরায় র‌্যাব সদর দপ্তরে গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘গত ৩ আগস্ট রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে শরফুল হাসান ওরফে মিশু হাসান এবং তার সহযোগী মো. মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসানকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা রাজধানীর অভিজাত এলাকায় পার্টি বা ডিজে পার্টি আয়োজনের তথ্য দেয়। এর ভিত্তিতেই বনানীর নিজ বাসা থেকে গত বুধবার আটক করা হয় শামসুর নাহার স্মৃতি ওরফে স্মৃতিমনি ওরফে পরীমনিকে। ওই বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মো. নজরুল ইসলাম ওরফে রাজ, পরীমনির ম্যানেজার আশরাফুল ইসলাম দীপু ও রাজের ম্যানেজার সবুজ আলীকেও। পরীমনির বাসা থেকে মিনি বার পরিচালনার বিভিন্ন সরঞ্জামাদিসহ ৩৩ বোতল বিভিন্ন প্রকার বিদেশি মদ, দেড় শতাধিক বিদেশি মদের বোতল, ইয়াবা ও সিসাসামগ্রী, ভয়ঙ্কর মাদক এলএসডি, আইস ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস উদ্ধার করা হয়।’

র‌্যাব মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত পরীমনি জানিয়েছেন- পিরোজপুরের কলেজে (এইচএসসি) পড়ার সময়েই তিনি চিত্রজগতে প্রবেশ করেন। এ পর্যন্ত তিনি ৩০টি সিনেমা এবং ৫ থেকে ৭টি টিভিসিতে অভিনয় করেছেন। পিরোজপুর থেকে ঢাকায় এসে চিত্রজগতে একটি দৃঢ় অবস্থান তৈরিতে নজরুল ইসলাম রাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এর মধ্যে ২০১৬ সাল থেকে পরীমনি অ্যালকোহলে (মদ) আসক্ত হয়ে পড়েন। তার ফ্ল্যাট থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি নিয়মিত অ্যালকোহল সেবন করে থাকেন। মাত্রাতিরিক্ত সেবনের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে বাসায় একটি মিনি বার স্থাপন করেছেন। আর মিনি বার থাকায় তার ফ্ল্যাটে ঘরোয়া পার্টির আয়োজন পরিপূর্ণতা পেত। রাজসহ আরও অনেকে তার বাসায় অ্যালকোহলসহ বিভিন্ন প্রকার মাদকের সরবরাহ করতেন এবং পার্টিতে অংশ নিতেন।’

রাজকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, ১৯৮৯ সালে খুলনার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দাখিল পাস করেন তিনি। পরে ঢাকায় গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন বলে দাবি। এর পর তিনি বিভিন্ন ব্যবসাবাণিজ্য ও ঠিকাদারি কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি শোবিজ জগতেও তার অনুপ্রবেশ ঘটে। বিভিন্ন সিনেমা-নাটকে নানান চরিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি নামে-বেনামে প্রযোজনায় যুক্ত হন। রাজ মাল্টিমিডিয়া নামেও তার একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ব্যবসায়িক জগৎ ও চিত্রজগতের দুই ক্ষেত্রে তার সংযোগ থাকায় তিনি অতিরিক্ত অর্থ লাভের আশায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিজ অবস্থানের অপব্যবহার করেন।

র‌্যাব জানায়, মিশু হাসান ও জিসানের সহযোগিতায় ১০-১২ জনের একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন রাজ। এই সিন্ডিকেটটি রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বিশেষ করে গুলশান, বারিধারা, বনানীতে পার্টি বা ডিজে পার্টির নামে মাদক সেবনসহ নানা অনৈতিক কর্মকা-ের ব্যবস্থা করে থাকে। ওইসব পার্টির জন্য তারা পেত বিপুল পরিমাণ অর্থ। প্রতিটি পার্টিতে ১৫-২০ জন অংশ নিতেন। তারা সাধারণত উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য। এ ছাড়া বিদেশেও প্লেজার ট্রিপের আয়োজন করত চক্রটি। একইভাবে উচ্চবিত্ত প্রবাসীদের জন্যও দুবাই, ইউরোপ ও আমেরিকায় এ ধরনের পার্টির আয়োজন করতেন তারা।

র‌্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন জানান, রাজ তার ‘রাজ মাল্টিমিডিয়া’ কার্যালয়টি অনৈতিক কাজেই ব্যবহার করতেন। সেখানে থাকা বিকৃত যৌনাচারের সরঞ্জাম দেখে র‌্যাব ধারণা করছে- রাজ মাল্টিমিডিয়ার ওই অফিসে পর্নোগ্রাফি তৈরি করা হতো। এর মাধ্যমেও অবৈধভাবে টাকা আয় করতেন রাজ। তার মোবাইল ও ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস থেকেও উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ পর্নোগ্রাফি ভিডিও। এ জন্য তার বিরুদ্ধে মাদক মামলার পাশাপাশি পর্নোগ্রাফি আইনে একটি মামলা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে রাজ জানিয়েছেন, অবৈধ আয়ের অর্থ নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসা, ড্রেজার আমদানি, বালু ভরাট ও ঠিকাদারি এবং শোবিজ জগতে বিনিয়োগ করতেন। তার সঙ্গে ব্যবসায় বেশ কয়েকজন অবৈধ অর্থের জোগানদাতার তথ্যও পাওয়া গেছে। তাদের ব্যবসায়িক কাঠামোতেও রয়েছে অস্বচ্ছতা। এগুলো তদন্ত করা হচ্ছে। অবৈধ অর্থ কানাডাতেও পাচার করেছেন রাজ।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, বুধবার বিকালে অভিযানের সময় পরীমনির বাসায় প্রবেশ নিয়ে অনেক জটিলতা তৈরি হয়। ওই চিত্রনায়িকা ভেতর থেকে তার বাসার দরজা খুলছিলেন না। প্রায় আধাঘণ্টা পর দরজা খুলে দিলে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার একটি দল সেখানে প্রবেশ করে। পরীমনি প্রথমে র‌্যাবের গোয়েন্দা দলের কাছে উচ্চপর্যায়ে তার অনেক যোগাযোগের কথা বলেন। পরে তার বাসা থেকে বিদেশি মদ, আইস ও এলএসডি মাদক উদ্ধার হলে তিনি চুপসে যান। এর পর অবশ্য আভিযানিক দলের সদস্যদের সহযোগিতা করেন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট এক র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, আটকের পর পরীমনিকে উত্তরা র‌্যাব সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা তাকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তখন চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য দেন নায়িকা পরীমনি। তার সঙ্গে উচ্চবিত্ত ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদস্থ কার্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথাও জানান। জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবের কর্মকর্তারা তার উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন, বিপুল পরিমাণ অর্থের উৎস এবং কিছু দন আগে বোট ক্লাবে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের অভিযোগ সম্পর্কেও জানতে চান। কোনো কোনো প্রশ্নের জবাবে অবশ্য নিশ্চুপ ছিলেন পরীমনি। তবে বেশিরভাগ সময়ই কান্নাকাটি করেছেন।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল কেএম আজাদ বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা (রাজ ও পরীমনি) অনেকের সম্পর্কেই তথ্য দিয়েছেন। তবে তারা ইল ইনটেনশন (খারাপ উদ্দেশ্যে) তথ্য দিয়েছেন কিনা, সেগুলো আমরা তদন্ত করে দেখছি।’
র‌্যাব সূত্র জানায়, সম্প্রতি হেলেনা জাহাঙ্গীর, মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌকে গ্রেপ্তারের ঘটনার ধারাবাহিকতায় পরীমনির বাসায় অভিযান চালানো হয়। পরে বনানী থানায় পরীমনি ও রাজের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পৃথক মামলা করে রথ্যাব। পরীমনির বিরুদ্ধে মামলায় তার ম্যানেজার আশরাফুল ইসলামকে আসামি করা হয়। আর রাজের সঙ্গে আসামি করা হয় তার ম্যানেজার সবুজ আলীকে। এ ছাড়া রাজের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে আরেকটি মামলা হয়েছে। বনানী থানার ওসি নূরে আজম মিয়া মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

চার দিনের রিমান্ডে পরীমনি
মাদকের মামলায় চিত্রনায়িকা পরীমনিকে চার দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। গতকাল রাতে শুনানি নিয়ে এ আদেশ দেন ঢাকার মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদ। আগের রাতে র‌্যাবের অভিযানে পরীমনিকে আটকের পর সন্ধ্যায় তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাতেই এ নায়িকাকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডে চেয়ে আবেদন করেন বনানী থানার পরিদর্শক সোহেল রানা। তবে পরীমনির পক্ষে তার আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল করে জামিনের আবেদন জানালেও তা নাকচ করে দেন বিচারক।

একই মামলার আসামি পরীমনির সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দীপু এবং অপর মামলায় গ্রেপ্তার চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ ও তার ব্যবস্থাপক সবুজ আলীকেও চার দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন বিচারক।
আদালতে আইনজীবীকে জড়িয়ে ধরেন পরীমনি

পরীমনিকে আদালত ভবনের নবম তলায় ওঠানো হয় লিফট দিয়ে। দুজন নারী পুলিশ দুই হাত ধরে তাকে এজলাসে নিয়ে যান। আসামির কাঠগড়ায় উঠেই তিনি এক আইনজীবীকে জড়িয়ে ধরেন। এ দৃশ্য দেখে পুলিশ দ্রুতই আইনজীবীকে সরিয়ে নিয়ে আসেন। সেই নাটকীয়তা শেষে রাত ৮টা ৩২ মিনিটে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। তখন চিত্রনায়িকার আইনজীবী কে হবেন, এ নিয়ে কিছুটা দ্বন্দ্ব চলে দুপক্ষের মধ্যে। শুরু হয় হট্টগোল। পরে বিচারক বলেন- ‘আসামির সঙ্গে কথা বলেন, উনি কাকে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেবেন।’ বিচারক এ কথা বলে এজলাস থেকে নেমে নিজের খাসকামরায় চলে যান। এর পর পরীমনি নীলাঞ্জনা রিফাত সুরভীকে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে আবার বিচারক এজলাসে ওঠেন। শুরু হয় রিমান্ড শুনানি।

আসামির পক্ষে তার আইনজীবী বলেন, ‘পরীমনি একজন স্বনামধন্য চিত্রনায়িকা। সবাই তাকে চিনে। তাকে যে সিস্টেমে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা দুঃখজনক। সাজানো ঘটনায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ক্যারিয়ার নষ্ট করতেই প্রতিহিংসার বশে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। তার অপরাধ খুবই সামান্য। চক্রান্তের শিকার তিনি। তার রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিন প্রার্থনা করছি।’

আসামির কাঠগড়ায় পরীমনি কখনো মাথা নুয়ে, কখনো মাথায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তবে আলোচিত নায়িকাকে দেখতে আদালতে ভিড় জমান আইনজীবীরাও। বাইরে ভিড় জমায় জনসাধারণ। পুলিশ সদস্যরা অবশ্য তাদের সেখান থেকে বারবার সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *