বাংলাদেশে লকডাউনের মধ্যেই চালু হয়েছে রফতানিমুখী শিল্পকারখানা৷ শনিবার শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফেরার ভয়াবহ ভোগান্তির পর ১৬ ঘন্টার জন্য লঞ্চ ও বাস চালু হয়৷ এই পরিস্থিতিতে সংক্রমণ আরো বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রধান৷
শনিবারের ঢাকামুখী জনস্রোত অব্যাহত ছিল রোববারও৷ কারখানা খোলার সিদ্ধান্তের ফলে আগের দিন শ্রমিকরা হেঁটে, ভ্যানে ও রিকশায় করে এসেছেন৷ শ্রমিকদের এই দুর্ভোগের পর তাদের ফেরার জন্য রোববার গণপরিবহণ চালুর ঘোষণা দেয় সরকার৷ সেই সুযোগে লঞ্চ, বাস ও সিটি সার্ভিস চালু হওয়ায় লকডাউনের কড়াকড়ি উঠে যায়৷ পোশাক খাতে ৪০ লাখ শ্রমিক কর্শরত হলেও মোবাইল ফোন অপারেটরদের হিসেবে কোরবানির ঈদে ঢাকার বাইরে গেছেন এক কোটি চার লাখ মানুষ৷ তাদের অনেকে লকডাউন শেষ হওয়ার আগেই ঢাকায় এসেছেন গাদাগাদি করে৷
বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্ল্যাহ বলেন, ‘মানুষ তো আসছে৷ বাস-লঞ্চ বন্ধ থাকলেও আসছে৷ তাদের তো আর থামানো যাচ্ছে না৷ কারাখানা খুললে শ্রমিকরা তো আসবেই৷ তারা ফেরিতে গাদাগাদি করে আসছেন৷ রিকশা-ভ্যানে করে আসছেন৷ স্বাস্থ্যবিধি বলতে কিছু নেই৷ এর চেয়ে বাস চলাচল অব্যাহত থাকলে ৮০ভাগ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা হতো৷ আর হঠাৎ চালু আর বন্ধের সিদ্ধান্ত দিলে তো হবে না৷ পরিবহণ শ্রমিকরা তো আর বাসে বসে থাকেন না যে নির্দেশের সাথে সাথেই বাস চালু করে দেয়া যায়৷ এ কেমন সিদ্ধান্ত বুঝে উঠতে পারছি না৷’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের লকডাউনের এই লেজেগোবরে অবস্থার জন্য কার্যত ব্যবসায়ীদের দায়ী করেছেন৷ তিনি রোববার বলেন, ‘সরকারে সঙ্গে ব্যবসায়ীদের এরকম কথা ছিলো না৷ ব্যবসায়ীদের অনুরোধে রপ্তানিমুখী শিল্প-কলকারখানা বিধি-নিষেধের আওতামুক্ত করেছে সরকার৷ ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আশপাশের শ্রমিকদের নিয়ে প্রথমে কারখানা চালু করবেন৷ ঈদের ছুটিতে গ্রামে যাওয়া শ্রমিকরা ৫ আগস্টের পর কাজে যোগ দেবেন৷ এতে কেউ চাকরিচ্যুত হবেন না৷ কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র৷ বাধভাঙা জোয়ারে মতো স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে রাজধানীমুখী জনস্রোত৷ এতে করোনা সংক্রমণের হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে৷’
কিন্তু বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম দাবি করেন, ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য সঠিক নয়৷ তিনি বলেন, ‘আমরা কাউকে লকডাউনের মধ্যে আসতে চাপ দেইনি৷ যারা এসেছেন তারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে এসেছেন৷’ তিনি জানান, ‘রোববার পোশাক কারখানায় ৯০ ভাগের বেশি শ্রমিক উপস্থিত ছিলেন৷ বাকিরা লঞ্চ ও বাস চালুর সুযোগে চলে আসবেন আশা করি৷’ যারা ঢাকা আসছেন তাদের সবাই তৈরি পোশাক শ্রমিক না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে অন্য খাতের শ্রমিক ও পেশার লোকজনও আছেন৷
এদিকে ঈদের বিরতির আগে-পরে দুই দফা লকডাউনেও করোনা সংক্রমণ কমেনি৷ বরং সংক্রমণের হার সার্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে৷ গত ২৪ ঘণ্টার হিসাবে করোনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ৯৭ শতাংশে, যা এ পর্যন্ত গড় হারের প্রায় দুই গুণ৷ ১ জুলাই প্রথম দফা লকডাউন শুরুর আগের দিন ৩০ জুন এই হার ছিলো ২৫ দশমিক ১৩ শতাংশ৷ ওইদিন ২৪ ঘণ্টায় মারা যান ১১৫ জন৷ এখন দৈনিক মৃত্যু ২০০-এর উপরে৷ গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ২৩১ জন৷ সারাদেশে এ পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ২০ হাজার ৯১৬ জন৷ এর মধ্যে গত সপ্তাহেই মারা গেছেন এক হাজার ৪৪৪ জন৷
এমন পরিস্থিতিতে লকডাউনের কার্যকারিতা ও ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে৷ ৫ আগস্টের পর লকডাউন আর থাকবে কীনা তা নিশ্চিত নয়৷ তবে বিধিনিষেধ থাকছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন৷
সার্বিক পরিস্থিতি দেখে লকডাউন ও করোনা পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ৷ তিনি বলেন, ‘১ জুলাই থেকে ১৪ দিনের লকডাউনে সংক্রমণ কমে আসছিল৷ আমরা তখন আরও ১০ দিন লকডাউনের সুপারিশ করেছিলাম৷ কিন্তু তা না করে ঈদে লকডাউন তুলে দেয়া হলো৷ ফলে সংক্রমণকে যে আটকানো হয়েছিলো তা আবার খুলে গেল৷ সংক্রমণ বাড়ল৷ দ্বিতীয় দফায় এবার পোশাক কর্মীদের গাদাগাদি করে যেভাবে ঢাকা আনা হলো তাতে আর কিছুই থাকলো না৷ সংক্রমণ এখন আরো বেড়ে যাবে৷’
তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে আর লকডাউনের পক্ষে না৷ এভাবে যদি প্রশাসন লকডাউন না মানাতে পারে তাহলে মনে হয় আর লককডাউন করাটা ঠিক হবে না৷ তা না করে বিধিনিষেধগুলো মানানো জরুরি৷ এখানে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না৷’
তবে এই বিশেষজ্ঞ আরো মনে করেন, এ অবস্থায় অফিস খুললেও বেশিরভাগ মানুষের ঘরে থেকে কাজ করা এবং গণপরিবহণ, দোকান, কলকারখানায় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে৷ দ্বিতীয়ত, প্রচুর পরীক্ষা করে তার ভিত্তিতে আইসোলেশন ও কোয়ারান্টিনের বিষয়গুলোতে জোর দিতে হবে৷ তৃতীয়ত, মাসে এক থেকে দেড় কোটি টিকা দিতে হবে৷ এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলে লকডাউনের প্রয়োজন নেই৷
তবে এসব বিষয়ে জাতীয় কারিগরি বিশেষজ্ঞ কমিটির আরো দু’দিন পর্যবেক্ষেণ করে সরকারকে তাদের মতামত জানাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি৷ চলমান লকডাউন শেষ হবে ৫ আগস্ট৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে