ঢাকাঃ করোনাকালে স্কুল-কলেজের ছুটি বাড়তে বাড়তে পার হয়েছে ৫০০ দিন। দীর্ঘ এই ছুটিতে ক্লাসের বিকল্প হিসেবে শিক্ষাকার্যক্রম চলছে টিভিতে, অনলাইনে। তবে ভার্চুয়ালি এই বিকল্প মাধ্যমে ক্লাস পরীক্ষা চললেও শিক্ষার্থীদের পঠন ও শিখন নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার এই দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষাকার্যক্রমের যে গতি থাকার কথা ছিল তা শ্লথ হয়েছে আর অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে আনন্দের খবর হচ্ছে ছুটি বা বন্ধের নোটিশ। কিন্তু করোনার কারণে বর্তমানের এই লম্বা ছুটি এখন বিষাদে পরিণত হয়েছে। যদিও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে অনলাইন ক্লাস চালু রয়েছে কিন্তু তাতে মিলছে না আশানুরূপ সাফল্য। মাঝে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা প্রসঙ্গে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হলেও বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তিতে দৈনিক করোনা সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে না নামলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে নারাজ শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
২০২০ সালের ১৭ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর কয়েক দফায় খোলার ঘোষণা দেয়া হলেও করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার স্কুল-কলেজ খোলার অনুমতি দেয়নি। কিন্তু এমন অবস্থায় শিক্ষায় অনিশ্চয়তাও যেন কাটছে না। স্কুল বন্ধ থাকায় একাধারে দীর্ঘ সময় বাসা-বাড়িতে বন্ধুদের আড্ডা ছাড়া একাকী থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মানসিক চাপ, হতাশা ও দুশ্চিন্তায় দিন পার করছে। কোনো কোনো শিক্ষার্থী আবার আত্মঘাতীও হয়ে উঠছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের ইতিহাসে একটানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫০০তম দিন পার হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার। শিক্ষাবিদদের মতে, প্রতিষ্ঠান বন্ধে পড়াশোনা নিয়ে অনিশ্চয়তায় অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছেড়ে গেমস, স্মার্টফোন আসক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া অনার্সে সেশন জটে পড়া অনেক শিক্ষার্থী হতাশায় মাদকে জড়িয়ে যাচ্ছে, যার প্রভাব সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে চোখ রাখলেই দেখা যায়।
এদিকে দীর্ঘ এই বন্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একই সাথে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীরাও আর্থিক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। ভাড়া বাড়িতে গড়ে ওঠা অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধও হয়ে গেছে। এক পরিসংখ্যান বলছে প্রায় ৬০ হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কিন্ডারগার্টেন আর্থিকভাবে দৈন্যদশায় রয়েছে। সরকারের কাছে প্রণোদনার আবেদন করেও তারা কোনো সাড়া পায়নি। আর এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী এখন অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান মালিক স্কুলভবন অন্য কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে কিংবা বাসা হিসেবে ভাড়া দিয়েছেন।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মো: মিজানুর রহমান নয়া দিগন্তকে জানান, বিগত ৫০০ দিন কত কষ্টে যে আমরা পার করেছি তা বোঝানো যাবে না। অনেক প্রতিষ্ঠান মালিক স্কুলভবন বিক্রি করে দিয়েছেন। আবার অনেক শিক্ষক অন্য পেশায় চলে গেছেন। আমরা সরকারকে এ কথা বলে বোঝাতে চেষ্টা করেছি যে, আমাদের সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠান মালিকরা আর্থিকভাবে কষ্টে আছেন। কিন্তু কোনো প্রণোদনা আমরা পাইনি। আমাদের ৬০ হাজার প্রতিষ্ঠানে ১০ লাখ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে। অনেকের শিক্ষাজীবনই এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘ বন্ধ প্রসঙ্গে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু এই প্রতিবেদককে বলেন, শিক্ষায় যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে সরকারকে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। স্কুল খোলার পর প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে একজন মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দিয়ে বাচ্চাদের মানসিকভাবে পড়ালেখায় আগ্রহী করে তুলতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য প্রফেসর ড. আলমগীর হোসেন করোনার এই দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষার্থীদের অনলাইন শিক্ষা নিয়ে সম্প্রতি এক ওয়েবিনারে বলেছেন, অনলাইনে কেনাকাটা ভালো করা যায়। কিন্তু শিক্ষা অর্জনে শতভাগ সফলতা আসে না। তিনি পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানো এবং ধারাবাহিক শিক্ষাকার্যক্রমের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। প্রসঙ্গত গত বছর ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ওই বছরের ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার।