দলের নাম অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নামছে আ.লীগ

Slider রাজনীতি


দেশে ‘আওয়ামী’ ও ‘লীগ’ শব্দ ব্যবহারকারী সংগঠনের সংখ্যা অনেক। প্রতিনিয়তই এমন শব্দ দিয়ে বিভিন্ন সংগঠন জন্ম নিচ্ছে। সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকুরিজীবী লীগ’ নামের একটি সংগঠন দেশব্যাপী নতুন কমিটি দিচ্ছে এবং শিগগিরই আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের স্বীকৃতি পাচ্ছে- এমন পোস্ট ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা দেখা দিয়েছে। খোদ আওয়ামী লীগের মধ্যেই সমালোচনা রয়েছে এসব সংগঠন নিয়ে। দলটির নেতারা বলছেন, শিগগিরই এসব ভুঁইফোড় সংগঠনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে।

আওয়ামী লীগের অভিযানের শুরুটা হয়েছে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে দিয়েই। ‘বাংলাদেশ আওয়ামী চাকুরিজীবী লীগ’-এর মতো নামসর্বস্ব সংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়াসহ নানা ধরনের বিভ্রান্তির অভিযোগের ভিত্তিতে দলের মহিলাবিষয়ক

উপকমিটির সদস্যপদ থেকে গতকাল শনিবার হেলেনাকে বাদ দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি আমাদের সময়কে বলেন, আওয়ামী লীগের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখেই হেলেনাকে দলের উপকমিটিতে নিয়েছিলাম। কিন্তু সে নানা সময়ে বিভ্রান্তিমূলক কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছে। ফলে তাকে আমরা উপকমিটি থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

অন্যদিকে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ম. রুহুল আমিন জানান, জেলা উত্তরের উপদেষ্টা পদ থেকে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে অব্যাহতির প্রস্তাব দিয়ে কেন্দ্রে ১৮ জুন ডাকযোগে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, ওই প্রস্তাবের ভিত্তিতে জেলার পদও হারাতে পারেন হেলেনা জাহাঙ্গীর।

চাকুরিজীবী লীগের ‘বয়স ৪ বছর’ হলেও সম্প্রতি সভাপতি পদে যুক্ত হন ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর। জানতে চাইলে তিনি ওই সংগঠনে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, সভাপতি হওয়ার বিষয়ে প্রস্তাব পেয়েছি, তবে এখনো কথা দিইনি। এ সময় তিনি সংগঠনটির ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ৬৪ জেলায় সংগঠনটির কার্যক্রম আছে। এতে অনেক মানুষের সম্পৃক্ততা আছে। আমি আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য। তাই আমার নেত্রী মেহের আফরোজ চুমকি অনুমতি দিলে চাকুরিজীবী লীগের দায়িত্ব নেব।

চাকুরিজীবী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মনির। মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ইমন বলেন, আমাদের সংগঠনের সভাপতি হেলেনা জাহাঙ্গীর। উনি সম্প্রতি আমাদের সঙ্গে এসেছেন। সেক্রেটারি মাহবুব মনির। আমরা আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে কাজ করার অনুমোদনের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি।

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলছেন, দুই শতাধিক সংগঠন রয়েছে যারা আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে সক্রিয় রয়েছে। দেশব্যাপী কমিটিও দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলের নেতারাও যাচ্ছেন ওইসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে। এসব সংগঠনের বেশিরভাগের উপস্থিতি দেখা যায় রাজধানীতে। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, পাবলিক লাইব্রেরি, জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনসহ রাজধানীর বেশ কিছু মিলনায়তনে আওয়ামী লীগের কর্মসূচির সঙ্গে মিল রেখে তারা কর্মসূচি পালন করে। অথচ ২০০৮ সালের আগে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, আওয়ামী শিল্পী গোষ্ঠী এবং আমরা সূর্যমুখীসহ হাতেগোনা চার-পাঁচটি সংগঠন ছিল। এ ছাড়া তেমন কোনো সংগঠনকে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের কথা বলতে দেখা যায়নি।

আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ১০টি। সর্বশেষ সহযোগী সংগঠন হয়েছে মৎস্যজীবী লীগ। অন্য সহযোগী সংগঠনগুলো হলো- যুবলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, তাঁতী লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, কৃষক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ। এ ছাড়া ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হচ্ছে জাতীয় শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ।

খোঁজ নিয়ে নামসর্বস্ব আরও কিছু সংগঠনের নাম পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ইলেকট্রিক লীগ, নাপিত লীগ, দর্জি লীগ, ফকির লীগ, হারবাল লীগ, ডিজিটাল লীগ, পর্যটন লীগ, সমবায় লীগ, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, স্বাধীনতা লীগ, প্রবীণ লীগ, আওয়ামী অভিভাবক লীগ, নাগরিক লীগ, তরুণ লীগ, তৃণমূল লীগ, জননেত্রী লীগ, তরিকত লীগ, রিকশা মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ, যুব হকার্স লীগ, নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ, ছিন্নমূল হকার্স লীগ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ, হোটেল শ্রমিক লীগ, হকার্স লীগ, প্রচার ও প্রকাশনা লীগ,
আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী পরিবহন শ্রমিক লীগ, মোটরচালক লীগ, চালক লীগ, পরিবহন শ্রমিক লীগ, বঙ্গবন্ধু হোমিওপ্যাথি লীগ, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক লীগ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ প্রভৃতি।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান বলেন, এসব সংগঠন আওয়ামী লীগের স্বীকৃত নয়। এসব সংগঠন নিয়ে দলীয় ফোরামে যখন আলোচনা হয়, তখনই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এগুলোর কোনো অনুষ্ঠানে আমরা যাব না। যাইওনি। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে এসব সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতে দেখা যায়- এ প্রসঙ্গে ফারুক খান বলেন, খুব একটা দেখাতে পারবেন না। হয়তো দু-একটা প্রোগ্রামে যান শুধু আবেগ থেকে। এই ধরুন ১৫ আগস্ট, বঙ্গবন্ধু বা এই সংক্রান্ত বিষয়ে প্রোগ্রাম হলে অনেক সময় নেতারা যান। তাদের কোনো রাজনৈতিক প্রোগ্রামে কেউ যান না। তিনি আরও বলেন, এখন তো লকডাউন চলছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও এসব সংগঠনের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হবে।

দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে এসব সংগঠনের কোনো সম্পর্ক নেই। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে এসব তথাকথিত সংগঠনের কোনো স্থান নেই, অনুমোদন নেই। সুতরাং কারও সংগঠনে ‘আওয়ামী’ বা ‘লীগ’ শব্দ ব্যবহার করলেই তা আওয়ামী লীগের সংগঠন হয়ে যায় না।

জাতীয় সংসদের হুইপ ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, এগুলো আওয়ামী লীগের অনুমোদিত বা সমর্থিত কোনো সংগঠন নয়। কিছু সুযোগসন্ধানী চক্র এসব কর্মে লিপ্ত আছে।

অন্যদিকে আমাদের কিছু নেতা সরল বিশ্বাসে এসব চতুর ব্যক্তিকে ছবি তুলতে, সেলফি তুলতে অনুমতি দেন। এরা এসব ছবি ব্যবহার করে প্রতারণা অব্যাহত রেখেছে। যে কোনো নামে যে কোনো নাগরিকের সংগঠন করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু এসব ব্যক্তি আওয়ামী লীগের নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে প্যাডসর্বস্ব সংগঠন করে আওয়ামী লীগের অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এই অপতৎপরতা বন্ধে আওয়ামী লীগ কাজ শুরু করেছে। তবে সর্বপ্রথম উদ্যোগ হওয়া উচিত, সস্তা প্রচারের লোভে যত্রতত্র যেনতেন কর্মসূচিতে যোগদান বা সেলফি তোলা থেকে বিরত থাকতে হবে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের। আমাদের সরল আশকারা পেয়ে এরা লালিত হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *