কৃষি প্রধান এই বাংলাদেশে কৃষি প্রকল্পে ঘাস, বীজসহ বিভিন্ন চাষ শিখতে কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণের নামে বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করছেন। তাদের পেছনে খরচ হচ্ছে বড় অঙ্কের অর্থ। আবার একই প্রকল্পে পরামর্শক সেবার পেছনে খরচ হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা। কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিতরণ প্রকল্পে (তৃতীয় পর্যায়) আইএমইডির পর্যালোচনায় এই সব তথ্য উঠে এসেছে। প্রকল্পে দুই বছরে ৪০ জন কর্মকর্তা বীজ উৎপাদন শিখতে চীন ও ভিয়েতনাম ভ্রমণ করেছেন। যাদের জন্য মাথাপিছু খরচ হয়েছে চার লাখ ৩৮ হাজার টাকা। আরো ৬০ জন কর্তা বিদেশে যাবেন বলে প্রকল্পের ডিপিপি থেকে জানা গেছে। অন্য দিকে পরামর্শক প্রতি জন মাসে খরচ হবে আড়াই লাখ টাকা।
অনুমোদিত প্রকল্প প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে তৃতীয় পর্যায়ে ১৬৫ কোটি ২৫ লাখ ৯২ হাজার টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালের জুলাইতে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন করতে প্রকল্পটি শেষ হবে ২০২২ সালের জুনে। কিন্তু প্রকল্পের তিন বছরের মাথায় খরচ বাড়িয়ে ১৮৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকায় অনুমোদন দেয়া হয়। প্রকল্পটি ২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত অগ্রগতি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৭ শতাংশ কম হয়েছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো, ইউনিয়নভিত্তিক ‘বীজ এসএমই’ স্থাপনের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে উন্নত বীজ নিশ্চিতকরণ, উন্নত বীজ ব্যবস্থাপনা ও আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে ডাল, তেল ও মসলা ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা, আমদানি হ্রাসের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়, মৌ চাষের মাধ্যমে ফসলের ফলন বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, মানব স্বাস্থ্যের পুষ্টি নিশ্চিত করা, উন্নত মানের বীজ ব্যবস্থাপনা ও মৌ চাষে মহিলাদের অংশগ্রহণে গ্রামীণ দারিদ্র্য হ্রাস করা।
প্রকল্পের মূল কাজগুলো হলো- ৩৬ হাজার ১৭১টি ব্লক প্রদর্শনী, কৃষক প্রশিক্ষণ ৬০০ ব্যাচ, কৃষকদের রিফ্রেসার্স কোর্স ১৫০ ব্যাচ, এএএও প্রশিক্ষণ ১৫০ ব্যাচ, রিফ্রেসার্স এএএও প্রশিক্ষণ ১৫০ ব্যাচ, ডিএইর অফিসার প্রশিক্ষণ ও তাদের রিফ্রেসার্স কোর্স, মৌ পালনে সার্টিফিকেট কোর্স, ১০০ জনের বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, ১৬ হাজার ৫৫০টি মাঠ দিবস, ২৫৬টি কৃষক পুরস্কার, ১৬ হাজার ৪৭০টি এসসিএ বীজ প্রত্যয়ন, ১২৮টি কৃষকদের উদ্বুদ্ধতকরণ ভ্রমণ, জাতীয়, আঞ্চলিক মিলে ৭৬টি কর্মশালা, মৌ বক্স ও মধু এক্সটাক্টর দুই হাজারটি, ময়েশ্চার মিটার দুই হাজার ৭৩৯টি, উন্নত বীজ সংরক্ষণ পাত্র ও শুকানোর উপকরণ মোট ১৮ হাজারটি ও ৫০ সেট এবং বীজ প্যাকেজিং ব্যাগ ৭১.৮৩ লাখ।
কৃষি অধিদফতর সূত্র জানায়, কৃষক পর্যায়ে দেশের ৬৪টি জেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সকল উপজেলায় চার হাজার ৫০০টি ইউনিয়নে ওয়ার্ডভিত্তিক বীজ এসএমই সৃষ্টির মাধ্যমে ডাল, তেল ও মসলার মানসম্মত বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, টেকসই উৎপাদন প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও মৌচাষ সম্পৃক্তকরণ থাকছে এ প্রকল্পের আওতায়। ।
আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০০ জন কর্মকর্তার বিদেশ প্রশিক্ষণ অনুযায়ী খরচ ধরা হয় চার কোটি ৩৮ লাখ আট হাজার টাকা। এখানে গত ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ এই দুই অর্থবছরে ২০ জন করে ৪০ জন বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। তারা চীন ও ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন। দেখা যায়, জনপ্রতি খরচ ধরা হয়েছে চার লাখ ৩৮ হাজার টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এখনো ৬০ জন যাওয়ার বাকি আছে। প্রকল্পের মেয়াদ আছে এক বছর। তবে করোনার কারণে এখন ভ্রমণ করতে পারছেন না তারা। সরকারি নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে করোনাকালীন সময়ে বিদেশ প্রশিক্ষণ ও ভ্রমণে।
অন্য দিকে প্রকল্পের জন্য দুই ধরনের কনসালট্যান্স নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। পরামর্শক খাতে বীজ বিশেষজ্ঞ এবং ব্যবস্থাপনা ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য দুই ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। প্রতিটিতে ৪৮ জনমাস ধরা হয়েছে। আর প্রতিটি খাতে এক কোটি ২০ লাখ টাকা করে মোট দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ফলে তাদের হিসাব অনুযায়ী প্রতি জনমাসে ব্যয় হবে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। উল্লেখ এই প্রকল্পে এর আগে দু’টি পর্যায়েও বিদেশ থেকে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। তার পরও প্রায় আড়াই কোটি টাকা খরচ করে তৃতীয় পর্যায়ে পরামর্শক নিয়োগ নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের এবং বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন।
এ দিকে তথ্যানুযায়ী, মৌ চাষের ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রথমে ১৫ লাখ টাকা ধরা হয়। কিন্তু পরে সেই খরচ অপ্রতুল বলে এক কোটি টাকা বাড়িয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। ময়েশ্চার মিটার কেনার জন্য প্রতিটির দর ধরা হয় ৩৫ হাজার টাকা। কিন্তু খাদ্য অধিদফতর জাপানিজ মিটার ব্যবহার করে বলে তারা মিটারের দাম ৬৫ হাজার টাকার প্রস্তাব করেছে। এখানে প্রতিটিতে ৩০ হাজার টাকা বেশি ধরা হয়েছে। কেনা হবে এক হাজার ২৬৬টি।
আইএমইডি বলছে, প্রকল্পে কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলে মোট ১৩ জন। যার মধ্যে চারজন কর্মকর্তা, সাতজন কর্মচারী এবং দুইজন পরামর্শক। পরামর্শক দু’জনকে ওপেন টেন্ডার মেথড (ওটিএম) নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পের খরচের বিভাজনে ৯৬ জনমাস ধরে দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দরা হয়েছে। সারা দেশে সাড়ে চার হাজারটি বীজ এসএমই গঠন করা হয়েছে। এসব এসএমইর বেশির ভাগই এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। স্বাধীনভাবে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে টিকে থাকার মতো সক্ষমতা অর্জন করেনি। চলমান প্রকল্পটি আগামী ২০২২ সালের জুনে সমাপ্ত হবে। ফলে মাঝ পথে এসে পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহায়তা না পেলে কঠিন চ্যালেঞ্জর মুখোমুখি হবে এইসব এসএমইরা। দেখা যাবে সরকারি শত কোটি টাকা ব্যয় করে সৃষ্টি করা তাদের বেশির ভাগই ঝরে যাবে।