জেলা-উপজেলার কোভিডের টিকা কেন্দ্রগুলোতে আগ্রহী এবং উদগ্রীব মানুষের উপচেপড়া ভিড়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য কর্মীরা বলেছেন, গত বছরের তুলনায় এবার টিকাকেন্দ্রগুলোতে মানুষের ভিড় অনেক বেশি এবং চাপ সামলাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা মনে করেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবার যেহেতু দেশটির গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মৃত্যুও বেড়েছে, সে কারণে মানুষ টিকা দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
সংক্রমণ বেশি এমন একটি জেলা রাজশাহীর সিভিল সার্জন বলেন, আগের বার ভ্যাকসিন না নিয়ে অনেকে ভুল করেছে।
তিনি বলেন, ‘তারা ভাবছে যে ভ্যাকসিন কখন শেষ হয়ে যায়- সেজন্য তারা আগে ভাগে নিতে চাইছে।’
তের কোটি মানুষ, ৫৭ লাখ টিকা
স্বাস্থ্য অধিদফতর বলেছে, টিকার ঘাটতি মিটিয়ে সবার জন্য তা নিশ্চিত করতে সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। তবে সরকারের ঘোষিত লক্ষ্য আর ক্ষমতার মধ্যে বিরাট ফারাক রয়ে গেছে।
সরকার বলছে, তারা দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ বা ১৩ কোটি মানুষকে টিকা দেবে, কিন্তু বর্তমান টিকা দান কর্মসূচীর শুরুতে তাদের হাতে আছে মাত্র ৫৭ লাখ ডোজ টিকা।
রাজশাহীর টিকা কেন্দ্রে লম্বা লাইন
দেশের যে জেলাগুলোতে লম্বা সময় ধরে করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং মৃত্যু উর্ধ্বমুখী রয়েছে, তার মধ্যে রাজশাহী অন্যতম।
ওই রাজশাহী শহরে এবং উপজেলাগুলোর টিকা দেয়ার কেন্দ্রগুলোতে এখন মানুষের উপচেপড়া ভিড়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা কার্যক্রমে রয়েছেন, এমন একজন স্বাস্থ্যকর্মী ফিরোজা খাতুন বলেছেন, চাহিদার তুলনায় তাদের কেন্দ্রে টিকা দেয়ার বুথ কম হওয়ায় মানুষের চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
‘একেক বুথে চারশো বা পাঁচ শ জন করে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। অনেক বড় লাইন। বুথ কম হওয়ায় তাদের টিকা নিতে অনেক সময় লাগছে’, বলেন স্বাস্থ্যকর্মী ফিরোজা খাতুন।
তিনি উল্লেখ করেন, টিকা কেন্দ্রে মানুষের চাপ আগের বারের তুলানায় এবার অনেক বেশি হওয়ায় দুরত্বও রক্ষা করা যাচ্ছে না।
সংক্রমণ এবং মৃত্যুর ঘটনা এখন মানুষ চোখের সামনে দেখছে এবং সে কারণেই টিকাকে একটা অবলম্বন হিসাবে বেছে নিতে চাইছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মানুষ কেন ধৈর্যহারা?
রাজশাহী জেলায় দ্বিতীয় দফায় গত ১৩ জুলাই থেকে টিকা দান কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর দুই দিনেই গোটা জেলায় সাত হাজারের মতো মানুষ টিকা নিয়েছেন।
এই সংখ্যা গত বছরের প্রথম দফার টিকা কার্যক্রমের দিনের গড় হিসাবেও অনেক বেশি বলে কর্মকর্তারা বলেছেন।
রাজশাহীর সিভিল সার্জন মোহাম্মদ কাইয়ুম তালুকদার বলেছেন, টিকার জন্য মানুষ এখন ধৈর্য্যহারা হয়ে পড়েছেন বলে তাদের মনে হচ্ছে।
“প্রতিটা মানুষই চাচ্ছে যে কত তাড়াতাড়ি ভ্যাকসিনটা নেয়া যাবে। মানে তারা একদিনের দেরিও সহ্য করতে চাচ্ছে না” মনে করেন মি: তালুকদার।
তিনি আরো বলেন, ভ্যাকসিন শেষ হয়ে যায় কিনা- সেই সন্দেহও কাজ করছে অনেক মানুষের মাঝে।
গ্রামের মানুষ কি আগ্রহী?
তিনি মনে করেন, গ্রামের মানুষ প্রথমে টিকা উপেক্ষা করেছে। কিন্তু এখন গ্রামে সংক্রমণ দেখে তারাই বেশি আগ্রহী হচ্ছে। আগের ভ্যকসিন না নিয়ে অনেকে ভুল করেছে, এমন ধারণা অনেকে হয়েছে।
‘তারা ভাবতেছে যে, আবার কখন ভ্যাকসিন শেষ হয়ে যাবে, সেজন্য আগে-ভাগে ভ্যাকসিনটা নিয়ে নেই,’ বলেন রাজশাহীর সিভিল সার্জন।
তিনি জানিয়েছেন, নিবন্ধন করার পরই তারিখ সর্ম্পকিত কোনো এসএমএস না পেয়েই অনেক মানুষ কেন্দ্রে এসে টিকার জন্য ভিড় করছেন। আবার নিবন্ধন না করেও অনেকে আসছেন। ফলে সমস্যা হচ্ছে।
শুধু রাজশাহী নয়, চাপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়াসহ সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে টিকা কেন্দ্রগুলোতে মানুষের ভিড়ের একই চিত্র পাওয়া গেছে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রথম দফার টিকা কার্যক্রমের সময় মানুষের আগ্রহের অভাবে এসব অনেক জেলার জন্য নির্ধাারিত পরিমাণ টিকা দিতে না পারায় সেই টিকা ঢাকায় ফেরত পাঠানো হয়েছিল।
তবে তারা এবার টিকা কেন্দ্রগুলোর ভিন্ন চিত্র দেখছেন।
টিকার জন্য মানুষ কেন এত উদগ্রীব?
চট্টগ্রাম থেকে একজন চাকরিজীবি শিউলী শবনম বলেছেন, এখনকার সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে তার আগ্রহ বেড়েছে।
‘আমি প্রথম বার করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। আর এখনকার পরিস্থিতিতে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে জটিলতা যাতে কম হয়, সেজন্য আমি এবার ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী,’ বলেন শবনম।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংক্রমণ এবং মৃত্যুর ঘটনা এখন মানুষ চোখের সামনে দেখছে এবং সে কারণেই টিকাকে একটা অবলম্বন হিসাবে বেছে নিতে চাইছে।
স্বাস্থ্য বিভাগ কী বলছে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেছেন, মানুষ যেন ধৈর্যহারা না হয়, সেটাই তারা চাইছেন।
তিনি বলেন, ‘মুশকিল হচ্ছে, মানুষ চায় যে, কালকে রেজিস্ট্রশন করেছে এবং আজকেই তাদের টিকা দিতে হবে।’
কিন্তু তাদের আগে যে বিশ লাখ লোক রেজিস্ট্রশন করে বসে আছে, তাদের প্রাপ্যটা আগে-সেটা তারা মানতে চায় না। এজন্যই ঝামেলাটা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক আলম।
তিনি বলেন, যে পরিমাণ টিকা এখন আসছে, তাতে সবাই টিকা পাবে। টিকা না পাওয়ার কোনো কারণ নাই। একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
কিন্তু অনেক জেলা থেকে চাহিদার তুলনায় টিকা সরবরাহের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কবে থেকে দ্বিতীয় ডোজ?
কোনো জেলায় দশ লাখ লোকের বসবাস হলে সেখান চল্লিশ হাজার টিকা সরবরাহ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আলম বলেছেন, চল্লিশ হাজার টিকা চল্লিশ হাজার মানুষকেই দেবে।
‘এর মাঝে আরো টিকা এলে তা সরবরাহ করা হবে। তখন আবার দেবে।’
তিনি জানিয়েছেন, এখন জেলা উপজেলায় যে পরিমাণ ডোজ দেয়া হয়েছে, সেগুলোর সবই প্রথম ডোজ হিসাবে দিতে বলা হয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেছেন, এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজের টিকা সারা দেশে সরবরাহ করা হবে।
সূত্র : বিবিসি