৭০ বছরের বৃদ্ধ আব্দুল হাকিম। গায়ে ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি, মাথায় সাদা-বেগুনি রঙের টুপি, পরনে পুরনো তবে পরিচ্ছন্ন চেক লুঙ্গি। মুখে মাস্ক পরে ফুটপাথের ওপর বসে নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার আশপাশে অনেক নারী-পুরুষ অপেক্ষা করছিলেন বিত্তবানদের দেয়া সহায়তা পাবার জন্য। একটি গাড়ি এলেই তারা ছুটে যাচ্ছিলেন ওই গাড়ির দিকে। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন আব্দুল হাকিম। তিনি মাথা নিচু করেই বসে থাকছেন। তবে আড় চোখে তাকিয়ে দেখছিলেন কেউ খাবারের একটি প্যাকেট নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসে কি না। কারণ আব্দুল হাকিম ভিক্ষুক নন, কাড়াকাড়ি করে খাবার বা ত্রাণের প্যাকেট তিনি নিতে পারবেন না।
হাতিরঝিলের মগবাজার প্রান্তে গতকাল শনিবার ফুটপাথের ওপর কথা হয় আব্দুল হাকিমের সাথে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘বাবা আমি ভিক্ষুক না, কিন্তু অনেক গরিব। ঘরে অসুস্থ স্ত্রী ও মেয়ের মুখে খাবার তুলে দেয়ার সামর্থ হারিয়ে ফেলেছি। তাই বাধ্য হয়ে মানুষের সহায়তা পাবার আশায় রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। অনেকে সহায়তাও দিচ্ছেন। তবে আমি পাচ্ছি না। কারণ এখানে অনেক নারী-পুরুষ ও শিশু সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করছেন। তারা টানাটানি করে প্যাকেট নিয়ে যায়। আমি তো তাদের মতো টানাহেঁচড়া করতে পারি না। তাই আমার ভাগ্যেও খাবার জোটে না।
আব্দুল হাকিমের গ্রামের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে। বর্তমানে থাকেন মগবাজার ৩ নম্বরের একটি বস্তিতে। কোনো ছেলেসন্তান নেই তার। তিন মেয়ের মধ্যে দুইজনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। ঢাকায় রিকশা চালিয়ে এবং স্ত্রী বাসাবাড়িতে বুয়ার কাজ করেই সংসার চালাতেন। কিন্তু নানান অসুখ এবং বয়সের ভারে এখন আর রিকশা চালাতে পারেন না। ভেবেছিলেন জীবনের বাকি সময়টা গ্রামে গিয়ে পার করবেন। কিন্তু সেখানে কোনো জমিজমা এবং কাজ না থাকায় অসুবিধায় পড়ে যান। পরে বয়স্ক ভাতা পাওয়ার জন্য স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে আবেদন করেন। এই টাকা পেলেও মোটামুটি চলতে পারবেন। কিন্তু চেয়ারম্যান মেম্বররা বয়স্কভাতার কার্ড পাবার জন্য পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। ওই টাকা দিতে পারেননি তিনি। যার কারণে ভাতা পাওয়ার কার্ডও তাকে দেয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপরই শুরু হয় করোনা মহামারী।
আব্দুল হাকিম বলেন, এত দিন ছোট মেয়ের সামান্য আয়ের ওপর স্বামী-স্ত্রী দুইজন বোঝা হয়েছিলাম। স্ত্রী বাসাবাড়িতে কাজ করে কিছু টাকা পেতো। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে মেয়েটার আয় কমে গেছে। স্ত্রীর কাজও বন্ধ। মেয়েটি কারখানায় কাজ করে যে টাকা পায় তাতে খাবারের ব্যবস্থাই ঠিকমতো করা যায় না। তার ওপর বাসাভাড়াসহ অন্যান্য খরচ তো রয়েছে। বয়স হওয়ায় নানা অসুখে ভুগতে হয়। স্ত্রী ও সন্তানের এমন কষ্ট দেখতে পারছেন না। তিনি বলেন, অনেকের কাছে শুনেছি রাস্তায় বড় বড় সাহেবরা গাড়ি নিয়ে এসে গরিবদের সাহায্য করে যান। গত দুই দিন কয়েকজন পথচারী ১০ টাকা ২০ করে ৭০/৮০ দিয়ে গেছেন। কিন্তু কোনো ত্রাণ বা খাবারের প্যাকেট পাইনি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, খুব বেশি লোক সাহায্য দিচ্ছেন না।
আবার যে পরিমাণ দিচ্ছেন তার থেকে মানুষ বেশি হওয়ায় কাড়াকাড়ি লেগে যাচ্ছে। ফলে সাহেবরা কোনো রকম কয়েকজনকে দিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছেন।