ঢাকা: বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী দেশে যদি কোন অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় জান-মালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা থাকে তখনই রাস্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর নিয়ে দেশে জরুরী অবস্থা জারি করতে পারেন।
সংবিধানে রয়েছে:
জরুরী-অবস্থা ঘোষণা ১৪১ক। (১) রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এমন জরুরী-অবস্থা বিদ্যমান রহিয়াছে, যাহাতে যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের দ্বারা বাংলাদেশ বা উহার যে কোন অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন, তাহা হইলে তিনি2[অনধিক একশত কুড়ি দিনের জন্য] জরুরী-অবস্থা ঘোষণা করিতে পারিবে 3[: তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ ঘোষণার বৈধতার জন্য ঘোষণার পূর্বেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতি-স্বাক্ষর প্রয়োজন হইবে।]
(২) জরুরী-অবস্থার ঘোষণা
(ক) পরবর্তী কোন ঘোষণার দ্বারা প্রত্যাহার করা যাইবে;
(খ) সংসদে উপস্থাপিত হইবে;
(গ) একশত কুড়ি দিন5[***]সময়ের অবসানে কার্যকর থাকিবে না:
তবে শর্ত থাকে যে, যদি সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়া অবস্থায় অনুরূপ কোন ঘোষণা জারী করা হয় কিংবা এই দফার (গ) উপ-দফায় বর্ণিত এক শত কুড়ি দিনের মধ্যে সংসদ ভাঙ্গিয়া যায়, তাহা হইলে তাহা পুনর্গঠিত হইবার পর সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে ত্রিশ দিন অতিবাহিত হইবার পূর্বে ঘোষণাটি অনুমোদন করিয়া সংসদে প্রস্তাব গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত উক্ত ত্রিশ দিনের অবসানে6[অথবা একশত কুড়ি দিন সময়ের অবসানে, যাহা আগে ঘটে,] অনুরূপ ঘোষণা কার্যকর থাকিবে না।
(৩) যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের বিপদ আসন্ন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে প্রকৃত যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ সংঘটিত হইবার পূর্বে তিনি অনুরূপ যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের জন্য বাংলাদেশ বা উহার যে কোন অংশের নিরাপত্তা বিপন্ন বলিয়া জরুরী-অবস্থা ঘোষণা করিতে পারিবেন।
জরুরী-অবস্থার সময় সংবিধানের কতিপয় অনুচ্ছেদের বিধান স্থগিতকরণ১৪১খ। এই সংবিধানের তৃতীয় ভাগের অন্তর্গত বিধানাবলীর কারণে রাষ্ট্র যে আইন প্রণয়ন করিতে ও নির্বাহী ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে সক্ষম নহেন, জরুরী-অবস্থা ঘোষণার কার্যকরতা-কালে এই সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪২ অনুচ্ছেদসমূহের কোন কিছুই সেইরূপ আইন-প্রণয়ন ও নির্বাহী ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কিত রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করিবে না; তবে অনুরূপভাবে প্রণীত কোন আইনের কর্তৃত্বে যাহা করা হইয়াছে বা করা হয় নাই, তাহা ব্যতীত অনুরূপ আইন যে পরিমাণে কর্তৃত্বহীন, জরুরী-অবস্থার ঘোষণা অকার্যকর হইবার অব্যবহিত পরে তাহা সেই পরিমাণে অকার্যকর হইবে।
জরুরী-অবস্থার সময় মৌলিক অধিকারসমূহ স্থগিতকরণ১৪১গ। (১) জরুরী-অবস্থা ঘোষণার 7[কার্যকরতা-কালে প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি] আদেশের দ্বারা ঘোষণা করিতে পারিবেন যে, আদেশে উল্লেখিত এবং সংবিধানের তৃতীয় ভাগের অন্তর্গত মৌলিক অধিকারসমূহ বলবৎকরণের জন্য আদালতে মামলা রুজু করিবার অধিকার এবং আদেশে অনুরূপভাবে উল্লেখিত কোন অধিকার বলবৎকরণের জন্য কোন আদালতে বিবেচনাধীন সকল মামলা জরুরী-অবস্থা ঘোষণার কার্যকরতা-কালে কিংবা উক্ত আদেশের দ্বারা নির্ধারিত স্বল্পতর কালের জন্য স্থগিত থাকিবে।
(২) সমগ্র বাংলাদেশ বা উহার যে কোন অংশে এই অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত আদেশ প্রযোজ্য হইতে পারিবে।
(৩) এই অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত প্রত্যেক আদেশ যথাসম্ভব শীঘ্র সংসদে উপস্থাপিত হইবে।]
বিশ্লেষনে দেখা যায়, সংবিধানে জরুরী অবস্থা নিয়ে যে ধারাগুলি আছে, দ্বিতীয় ১৪১ক (৩) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, যুদ্ধ বাবহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরিণ গোলযোগের দ্বারা বিপদ আসন্ন বলে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হলে প্রকৃত যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন।
তৃতীয়ত, ১৪১ক(১) উপ-অনুচ্ছেদের শর্ততে বলা হয়েছে যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হলে ঘোষণার পূর্বেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরের প্রয়োজন হবে। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে জরুরি অবস্থা ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। অবশ্য জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরের শর্তটি যোগ করার পেছনে বাস্তব কারণও আছে। রাষ্টপতি তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার করে ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্ত ব্যতীত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। এরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করেই প্রতিস্বাক্ষরের বিধান করা হয়েছে। জরুরি অবস্থার উদ্ভব হয়েছে কিনা কিংবা জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য বাংলাদেশ বা এর কোন অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন কিনা এ সম্পর্কে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত। কোনো আদালতে তাঁর ষোষণারসযর্থাথতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যাবে না। আদালত শুধু এইটুকই দেখতে পারবে যে, জরুরি অবস্থা ঘোষণার আগে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর নেয়া হয়েছেল কিনা।
জরুরি অবস্থা ঘোষণা হলে তার ফলাফল:
১. জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পর পরবর্তী কোনো ঘোষণার মাধ্যমেরা তা প্রত্যাহার করা যাবে।
২. জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার পর তা সংসদে উপস্থাপন করতে হবে এবং ঘোষণা ১২০ দিনের মধ্যে সংসদের প্রস্তাব দ্বারা অনুমোদিত না হলে ১২০ দিন পর তার কোনো কার্যকারীতা থাকবে না।
৩. যদি সংসদ ভেঙ্গে যাওয়া অবস্থায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয় অথবা ঘোষণার ১২০ দিনের মধ্যে যদি সংসদ ভেংঙ্গ যায় তাহলে সংসদ পুর্নগঠিত হওয়ার পর প্রথম
বৈঠকের তারিখ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে সংসদের প্রস্তাবের মাধ্যমে উক্ত ঘোষণা অনুমোদিত না হলে ৩০ দিন পর তার কোনো কার্যকারীতা থাকবে।
৪. জরুরি অবস্থা ঘোষণার সাথে সাথে সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪২ অনুচ্ছেদ বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলো স্থগিত হয়ে যাবে এবং যতদিন জরুরি অবস্থা বলবৎ থাকবে ততিদিন ঐ অধিকারগুলো স্থগিত থাকবে। ফলে, নির্বাহী বিভাগ এসকল মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। আবার সংসদও এ সকল মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি যে কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারবে। জরুরি অবস্থা যখনই প্রত্যাহার করা হবে তখনই উক্ত অধিকারগুলোপুনরুজ্জীবিত
হবে।
৫. জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর রাষ্ট্রপতি আদেশ দ্বারা যে কোনো মৌলিক অধিকারের বলবৎকরণের অধিকার স্থগিত করতে পারবেন।
উল্লেখ্য, ১৪১খ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জরুরি অবস্থা ঘোষণার সাথে সাথে ৬টি মৌলিক অধিকার স্থগিত হয়ে যায়। ফলে, এদের বলবৎকরণের প্রশ্ন থাকেনা। বাকী থাকে ১২টি মৌলিক অধিকার। জরুরি অবস্থা চলাকালে এ ১২ টি অধিকার বহাল থাকে। তবে ১৪১(গ) অনুযায়ী উক্ত ১২টি অধিকারের যেকোনটির বা সবগুলো বলবৎ করনের অধিকারকে রাষ্ট্রপতি আদেশের মাধ্যমে স্থগিত করে দিতে পারেন দেশে এ পর্যন্ত যতোবার জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে, প্র্রত্যেকবারই ১২টি অধিকারও স্থগিত করা হয়েছে। কাজেই জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে এমন বিধান করা হয়েছে যাতে সবগুলো মৌলিক অধিকারই স্থগিত করা যায়।
লেখক:
রিপন আনসারী
সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী