মায়ের ভালোবাসার কাছে সকল ভয়ই যেন তুচ্ছ। করোনা উপসর্গ নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি মাহীকে নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তার মা। ছবি: জীবন আহমেদকরোনার সংক্রমণ হু হু করে বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যু। সারা দেশই এখন করোনার হট স্পট। দেশে একদিনে করোনায় শনাক্ত ও মৃত্যুতে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সর্বোচ্চ ১৬৪ জনের মৃত্যু এবং রেকর্ড সংখ্যক ৯ হাজার ৯৬৪ জন শনাক্ত হয়েছে গতকাল। ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। হাসপাতালে ৫০ শতাংশের বেশি করোনা রোগী গ্রামের বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জানিয়েছেন। এসব রোগীর রোগের তীব্রতা অনেক বেশি হওয়ার পর হাসপাতালে আসছেন।
বেশ কয়েকটি জেলায় আইসিইউ ও অক্সিজেনের অভাবে রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে প্রায় প্রতিদিন। এর আগে সাতক্ষীরা ও বগুড়া জেলায় অক্সিজেনের অভাবে করোনা রোগী মারা যাওয়ারও অভিযোগ উঠে। পাবনায় অক্সিজেন সংকটে রোগীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই অবস্থায় ঢাকার হাসপাতালগুলোতেও সংকট বাড়ছে। রাজধানীর বাইরে যথাযথ চিকিৎসা না পেয়ে অনেকেই রোগী নিয়ে রাজধানীতে ছুটে আসছেন। তাদের অধিকাংশই প্রথমে সরকারি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে আইসিইউ’র জন্য ছুটছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড সংখ্যক ১৬৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে চলতি মাসের ৪ঠা জুলাই ১৫৩ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ১৫ হাজার ২২৯ জনে। টানা ৯দিন ধরে দৈনিক মৃত্যু একশ’ ছাড়িয়েছে। নতুন করে দেশে সর্বোচ্চ শনাক্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৯৬৪ জন। যা দৈনিক শনাক্তের এই সংখ্যা এতদিন এর আগে দেখা যায়নি দেশে। চলতি বছরের ৩০শে জুন ৮ হাজার ৮২২ জন শনাক্ত হয়েছিল। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮১ জন। গত বছরের ৮ই মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হন এবং করোনা রোগী প্রথম মারা যান ওই বছরের ১৮ই মার্চে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ হাজার ১৮৫ জন এবং এখন পর্যন্ত ৮ লাখ ৩৯ হাজার ৮২ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। সরকারি তথ্য মতে, ৬০৫টি পরীক্ষাগারে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৫ হাজার ৪২টি নমুনা সংগ্রহ এবং ৩৪ হাজার ২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৬৭ লাখ ৫৭ হাজার ৫৬২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং এ পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১৬৪ জনের মধ্যে পুরুষ ১০৯ জন এবং নারী ৫৫ জন। এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে পুরুষ মারা গেলেন ১০ হাজার ৭৮৫ জন এবং নারী ৪ হাজার ৪৪৪ জন। বয়স বিবেচনায় ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের মধ্যে ৬০ বছরের উপরে রয়েছেন ৮৩ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৪৭ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ১৮ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ১২ জন এবং ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৪ জন। বিভাগভিত্তিক বিশ্লেষণে তাদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৪০ জন, চট্টগ্রাম বিভাগের ১৮ জন, রাজশাহী বিভাগের ১৬ জন, খুলনা বিভাগের ৫৫ জন, বরিশাল বিভাগের ৯ জন, সিলেট বিভাগের ৮ জন, রংপুর বিভাগের ১৬ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগের মারা গেছেন ২ জন। ১৬৪ জনের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন ১২৩ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ২৫ জন এবং বাসায় ১৫ জন। হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে ১ জনকে।
এদিকে বিভাগভিত্তিক শনাক্তের হার বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের মোট শনাক্তের ৪২ দশমিক ৬৫ শতাংশ রোগী রয়েছেন ঢাকা বিভাগে। গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা বিভাগে শনাক্ত হয়েছেন ৪ হাজার ২৫০ জন। এই বিভাগে শনাক্তের হার ২৬ দশমিক ১৩ শতাংশ। এই বিভাগেও সামান্য বাড়ছে করোনার রোগী। ঢাকা জেলায় (মহানগরসহ) শনাক্তের হার ২৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। ময়মনসিংহ বিভাগে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৩৮৯ জন। শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ৮০ শতাংশ। চট্টগ্রামে বিভাগে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৩৬৭ জন। শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ৪৫ শতাংশ। রাজশাহীতে শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ১২৩ জন। শনাক্তের হার ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। রংপুর বিভাগে শনাক্তের সংখ্যা ৬৭৬ জন। শনাক্তের হার ৩৪ শতাংশ দশমিক ২২ শতাংশ। খুলনা বিভাগে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ৪৭০ জন। শনাক্তের হার ৩৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে শনাক্তের সংখ্যা ৪৩৬ জন। শনাক্তের হার ৪৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। একই সময়ে সিলেট বিভাগে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২৫৩ জন। শনাক্তের হার ৩৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
করোনায় ৮ দিনে ১ হাজার মৃত্যু ছাড়িয়েছে: দেশে করোনায় মৃত্যু দ্রুতগতিতে বাড়ছে। দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। দেশে গত ৮ দিনে করোনায় ১ হাজার ৫৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ভাইরাসটিতে গতকাল সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৬৪ জনের মৃত্যু হয়। ৪ঠা জুলাই মারা গেছেন ১৫৩ জন, ৩রা জুলাই ১৩৪ জন, ২রা জুলাই ১৩২ জন, ১লা জুলাই ১৪৩ জন, ৩০শে জুন ১১৫ জন, ২৯শে জুন ১১২ জন এবং ২৮শে জুন ১০৪ জন মারা যান।
করোনা আক্রান্তদের অর্ধেকের বেশি গ্রামাঞ্চলের: গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জানান, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা। তিনি বলেন, এসব রোগী রোগের তীব্রতা অনেক বেশি হওয়ার পর হাসপাতালে আসছেন। তিনি বলেন, ৪৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমরা ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করেছি। তারা জানিয়েছেন, বেশির ভাগ রোগী গ্রাম থেকে আসছেন এবং তারা গুরুতর অবস্থায় এসে ভর্তি হচ্ছেন। তিনি আরও জানান, সংক্রমিত হওয়ার পরেও অনেকে জানেন না কোভিড-১৯ সম্পর্কে। তারা একে স্বাভাবিক ফ্লু বলে মনে করছেন। তিনি বলেন, এখন বর্ষার মৌসুম। অনেকেই করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলেও সাধারণ সর্দি-জ্বর বা কাশিতে আক্রান্ত বলে ধরে নিচ্ছেন। পরীক্ষা করাচ্ছেন না বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন না। তিনি আরও বলেন, মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের গ্রামে গ্রামে মাইকিং করার পরামর্শ দিয়েছি। বাড়ি বাড়ি রোগীর খোঁজ রাখতে বলেছি। তিনি আরও জানান, বৃহস্পতিবার থেকে গণটিকাদান কর্মসূচির অনলাইন নিবন্ধন পুনরায় শুরু হবে। তবে বয়সসীমা ৪০ বছর থেকে কমিয়ে ৩৫ বছর করা হবে।