আমীর খসরু
প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে। (বাংলাদেশ সংবিধান, প্রথম ভাগ, অনুচ্ছেদ-৭। (১)) সকল সময় জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।(বাংলাদেশ সংবিধান, দ্বিতীয় ভাগ, রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি। অনুচ্ছেদ-২১। (২))
ভোটারবিহীন হিসেবে পরিচিত জাতীয় সংসদে গত ২৮ জুন খোদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদেরই বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের ক্ষোভপূর্ণ আলোচনার মধ্য দিয়ে সরকার পরিচালনার অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় বেরিয়ে এসেছে। সংবাদমাধ্যমের কেউ অথবা দলনিরপেক্ষ কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি এ কথাগুলো নিজ উদ্যোগে বললে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় পড়ে যেতেন নিশ্চিত। কিন্তু যেহেতু তারা সংসদ সদস্য সে কারণে তাদের কিছুই হয়নি। ওই আলোচনায় প্রশ্নটি তারা করেছেন যে, সরকার চালায় কারা বা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে কে? সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, জাতীয় সংসদ সদস্যদের চেয়ে সরকার অনেক বেশি আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে।
সংসদে আরো বলা হয়, দেশে এখন রাজনীতি নেই। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। সরকারের মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় নেই এবং সরকারের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে বলেও আলোচনায় বলা হয়েছে। সংসদ সদস্যরা আমলাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, সংসদ সদস্যদের অবস্থান আমলাদের চেয়ে ওপরে। ওই আলোচনায় আরো বলা হয়, তারা দেশে দুর্নীতি করে কানাডার বেগম পাড়ায় বাড়ি করছেন। রাজনীতিবিদেরা এখন তৃতীয় সারিতে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আচারে সংসদ সদস্যদের অবস্থান সচিবদের ওপরে, এটি খেয়াল রাখতে হবে।
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা এবং বহুবারের সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ ক্ষোভের সাথেই বলেন, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (রাষ্ট্রীয় পদ-মর্যাদাক্রম) অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা সচিবের ওপরে, এটা খেয়াল রাখতে হবে।
জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, দেশে কোনো রাজনীতি নেই। আওয়ামী লীগের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে, কারণ কোনো রাজনীতি নেই। প্রত্যেকটি জেলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সচিবদের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে কথা বলেন। আর এমপি সাহেবরা বসে থাকেন দূরে। তারপর বলেন, ডিসি সাহেব আমি একটু কথা বলব প্রধানমন্ত্রীর সাথে। এই হচ্ছে রাজনীতিবিদদের অবস্থা। প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সাথে যখন কথা বলেন, তখন এমপিদের কোনো দাম থাকে না।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শরিক দল জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সরকারের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, লকডাউন-শাটডাউন নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি এবং তা ঘনঘন সংশোধন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অদল-বদল করা এসব বক্তব্য বিবৃতির মধ্য দিয়ে অস্থিরতারই প্রকাশ ঘটছে। তিনি আরো বলেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ নয়টি মন্ত্রণালয় সম্পৃক্ত। এই নয়টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা লক্ষণীয়। এসব বক্তব্যের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দূরবর্তী ক্ষোভের কারণ। অনেকেই মনে করছেন, গত বছরের মে মাসে করোনা প্রতিরোধ ও জেলা পর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকারের জ্যেষ্ঠ সচিব, সচিব এবং সচিব পদমর্যাদার ৬৪ জন কর্মকর্তাকে প্রতিটি জেলার দায়িত্ব দেয়ায় এ ক্ষোভ জানানো হচ্ছে। কিন্তু এসব পুঞ্জিভূত ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
এসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কয়েকটি তথ্য আমজনতা জানতে পেরেছে-
১. দেশে কোনো রাজনীতি নেই; অর্থাৎ রাজনীতি শূন্যতায় ভুগছে বাংলাদেশ।
২. সরকার আমলা নির্ভর; জনগণ এবং রাজনীতিবিদ নির্ভর নয়।
৩. সংসদ সদস্যরা নিজেরাই মনে করেন, তারা আমলাদের অধস্তন হয়ে পড়েছেন। এটি যদি সত্য হয়, তবে তা রাজনৈতিক পথ-পদ্ধতি এবং পুরো রাষ্ট্র কাঠামোর জন্যই ক্ষতিকর।
৪. আমলারা দুর্নীতি করে এবং তারা অনেক রাজনীতিবিদদের চেয়ে এগিয়ে। এ কথাও যদি সত্য হয়, তাহলে দুর্নীতি বিরোধী বক্তব্য এবং কার্যক্রম কতটা বাস্তবায়নযোগ্য হবে।
যেসব কথাগুলো সংসদে হয়েছে, তা সাধারণত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কি পরিস্থিতি হতে পারত, তা সহজেই অনুমেয়। এ কথাটি সত্য যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা ধরনের ভয়ে এখন আমার মতো অনেকেই সীমাহীন ভীতির কারণে সেলফ সেন্সরশিপের মধ্যে আছেন অর্থাৎ দেখিয়াও দেখি নাই, বুঝিয়াও বুঝি নাই- এমন দশা আর কি! কারণ এখন দেখা নিষিদ্ধ, বলা নিষিদ্ধ, চিন্তা নিষিদ্ধ।
দীর্ঘকাল রাজনীতিক বিজ্ঞানীদের নিরন্তর চিন্তার ফসল হচ্ছে এই যে, সংবিধান নামক যে গ্রন্থখানী রয়েছে তাতে রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগ (সরকার), আইনসভা (পার্লামেন্ট) এবং বিচার বিভাগের কার্যক্রম ও ক্ষমতার পরিধি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সব সময়ই রাজনীতিবিহীন অথবা জন-রাজনীতিবিমুখ সরকারগুলো এটি মানতে চায় না। প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের জন্য খ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ড মিলসহ এ ধারার রাজনীতি বিজ্ঞানীদের ধারণা বাংলাদেশে এমনভাবে ভুল প্রমাণিত হবে – তা জন স্টুয়ার্ড মিল সাহেবরা কোনোদিন জীবদ্দশায় ভেবেছেন কিনা সন্দেহ। রাজনীতি বিজ্ঞানের একজন সামান্য ছাত্র হিসেবে বলতে পারি যে, এক ও একক কেন্দ্রীকতার সরকারের নির্বাহী বিভাগ বাকি দুটো বিভাগকে প্রায়শই অধস্তন বানিয়ে ফেলে। আর এজন্য এক ও একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি কোয়ালিশন বা যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন হয়। বিষয়টি যেহেতু রাজনৈতিক নয়, সে কারণে সব ধরনের আমলা শ্রেণীর ওপর সরকারের নির্ভরতা বেড়ে যায়, এটি শুধু এক ধরনের আমলাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। আমলারাও এই সুযোগের জন্য নিজেদের যথাসাধ্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। অতীতের সব জনবিচ্ছিন্ন সরকারের ক্ষেত্রে এমনটি দেখা গেছে। আবার এটি ঘটে থাকে স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেটিক পদ্ধতিতে। অর্থাৎ তত্ত্বটি হচ্ছে, অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে রাজনীতিহীনতা বা রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। আবার শূন্যতা পূরণ হয় ভিন্ন পন্থায়। এক্ষেত্রে আমলারা কাজটি করে ওই শূন্যতার সুযোগেই। তবে দুর্ভাগ্য যে, তোফায়েল আহমেদ, হাসানুল হক ইনু বা ফিরোজ রশীদ সাহেবরা এখন যতই কান্নাকাটি করুন না কেন, কোনো কাজ হবে না। কারণ তারাই এক সময়ে এই মসৃণ পথ তৈরির প্রথম দিকের সৈনিক ছিলেন।
এক্ষেত্রে আমলাদের সত্যিকারের কি ভূমিকা হওয়া উচিত, তা সবার জানা দরকার। আমলাতন্ত্র হচ্ছে অর্থাৎ সংবিধানে যেমনটি বলা হয়েছে, সকল সময় জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। (বাংলাদেশের সংবিধান, অনুচ্ছেদ ২১। (২) -এর বাইরে আমলারা কেউ নন। আমলাতন্ত্র চলবে Higheriacical chain of Command বা উচ্চতর পদক্রমিক বিন্যাসের ভিত্তিতে। কিন্তু সবচেয়ে উর্ধ্বে থাকবেন জনগণ দ্বারা নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এটি প্রমাণিত সত্য যে, জনসম্পৃক্ততা না থাকলে রাজনীতিহীনতা যেমন বাড়তে থাকে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে আমলানির্ভরতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানকল্প কাহিনী লেখক বেন বোভা (১৯৩২-২০২০) বলেছিলেন, “Red tape or excessive bureaucracy has killed more people than bullets…”. অর্থাৎ অতিমাত্রার আমলাতন্ত্র বা লাল ফিতা বুলেটের চেয়েও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে।
নীতি-নির্ধারকদের এ কথাটি মনে রাখতে হবে- জাতীয় সংসদ সদস্যদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহি:প্রকাশ কেন হয়েছে তা নীতি-নির্ধারকদের অনুসন্ধান করতে হবে। তবে এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিষয়টি জনগণ ইতোমধ্যে বুঝে গেছে। কিন্তু যাদের বোঝার কথা আসলে তাদেরই বিষয়টি বোঝা উচিত ছিল। আমিন।
(আমীর খসরু, প্রধান নির্বাহী, স্টাডি গ্রুপ অন রিজিওনাল এ্যফেয়ার্স, ঢাকা)