২৫ বছর বয়সী রোজিনা বেগম। ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। করোনার কারণে বাসায় থাকাতে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন দীর্ঘদিন। ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়া করে ডাক্তার দেখাতেন। সম্প্রতি ঠাণ্ডাজ্বরের সঙ্গে কাশি হওয়ায় পরিবারের সদস্যরা স্থানীয় হাসপাতালে টেস্ট করালে করোনা ধরা পড়ে। রোগীর অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তার অক্সিজেন লেভেল প্রায়ই নেমে যায়। আইসিইউতে চিকিৎসা দিলে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।
কিন্তু ঢাকা মেডিকেলের ২০টি আইসিইউ শয্যার সবক’টিতে রোগী ভর্তি রয়েছেন। সকাল থেকে অনেক চেষ্টার পরেও আইসিইউ-এর ব্যবস্থা না করতে পেরে গ্রিন রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় রোজিনাকে। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও একই চিত্র। হাসপাতালটির ১০টি আইসিইউ শয্যার একটিও খালি নেই। সব বেডে রোগী ভর্তি। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর স্বজন জানান, সম্প্রতি তার বাবা খাদেম হাওলাদার করোনা আক্রান্ত হন। তার বয়স ৫৭ বছর হওয়াতে কোনো প্রকার ঝুঁকি না নিয়ে তৎক্ষণাৎ নাটোরের আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। ওই হাসপাতালে ভর্তি করলেও সেখানে কোনো আইসিইউ চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। রোগীর অবস্থা রাতারাতি খারাপ হয়ে পড়লে এম্বুলেন্সযোগে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে আইসিইউ বেড খালি না থাকায় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই হাসপাতাল থেকেও আইসিইউ বেড খালি নেই বলে ফেরত পাঠানো হয়। সেখান থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ মোট চারটি হাসপাতালে আইসিইউ বেড না পেয়ে অবশেষে ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে রোগীকে ভর্তি করতে নিয়ে যান।
ঢাকার হাসপাতালগুলোতে বাইরের জেলা থেকে আসা কোভিড রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এভাবে হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে চিকিৎসাসেবা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। হাসপাতালগুলোতে দুই সপ্তাহ আগে পর্যন্ত যেখানে রোগীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। হঠাৎ করে কয়েকদিনের মধ্যে তুলনামূলকভাবে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিগত দিনের চেয়ে আক্রান্ত রোগী ভর্তির হার কয়েকগুণ বেড়েছে বলে জানিয়েছে হাসপাতালগুলো। কোভিডের জন্য নির্ধারিত এই হাসপাতালগুলোতে কোনো আইসিইউ শয্যা খালি নেই। সরজমিনে রাজধানীর সরকারি কোভিড বিশেষায়িত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ৫০০ শয্যার মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, কুর্মিটোলা, বিএসএমএমইউসহ একাধিক হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেছে একই চিত্র।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ১৯৫ জন করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালটিতে মোট করোনা শয্যাসংখ্যা ২৬৩টি। এরমধ্যে খালি আছে ৮৯টি শয্যা। হাসপাতালটিতে থাকা মোট ১০টি আইসিইউ শয্যার সবগুলোতে রোগী ভর্তি রয়েছেন। গত এক সপ্তাহের মধ্যে হাসপাতালটিতে ঢাকার বাইরে থেকে আসা আক্রান্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। যার মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ রোগী আসছেন ঢাকার বাইরে থেকে।
এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. খলিলুর রহমান বলেন, ঢাকার পার্শ্ববর্তী এবং বাইরের রোগী বেশি আসছে। গত শনিবার হাসপাতালটিতে ৩৫ জন করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি হন। এর আগে রোগীর সংখ্যা আরও কম ছিল। সেখান থেকে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গিয়ে ২৪ ঘণ্টায় মোট ১৯৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর আগে সর্বোচ্চ রোগী ৭০ থেকে ৮০ জন পর্যন্ত ছিল। এখন যেটা দ্বিগুণ হয়েছে। এভাবে রোগী সংখ্যা বেড়ে গেলে সিট ক্রাইসিস দেখা দিবে। তখন হয়তো ননকোভিড রোগীদেরকে সরিয়ে সেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে বলে জানান তিনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ ভাগ করোনা আক্রান্ত রোগী হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসছেন। গত শনিবার ভর্তি হওয়া ৪০ জন রোগীর মধ্যে ৮ থেকে ৯ জন্য রোগী ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন। বর্তমানে ৫৯৩ জন রোগী ভর্তি আছেন। অর্থাৎ ৭০৫টি শয্যার মধ্যে ১৮৩টি খালি রয়েছে। এছাড়া ২০টি আইসিইউ শয্যার একটিও খালি নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেছেন, গত এক সপ্তাহ আগ পর্যন্ত এতো রোগী হাসপাতালে আসেনি। এখন প্রতিদিনই ঢাকার বাইরে থেকে রোগী আসছেন। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫ জন ভর্তি হচ্ছেন। ঢাকার বাইরে থেকে এখন প্রতিদিন ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত রোগী ভর্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মুগদা হাসপাতাল সূত্র জানায়, বর্তমানে হাসপাতালটির করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন ১৯৪ জন রোগী। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালটিতে ভর্তি হয়েছেন ২৯ জন। হাসপাতালটির মোট শয্যা ৩৫০টি এবং আইসিইউ শয্যা ২৪টি। আইসিইউ শয্যার সবগুলোই পূর্ণ রয়েছে। মুগদা হাসপাতালের পরিচালক ডা. অশিন কুমার নাথ বলেন, প্রতিদিন প্রায় ৩০ ভাগের বেশি রোগী ঢাকার বাইরে থেকে আসছেন। আইসিইউ, এইচডিইউ সবগুলোতে রোগী ভর্তি রয়েছেন। এক্ষেত্রে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে আমাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে যতটুকু সম্ভব রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবো।
৩ ঘণ্টায় ২৮ রোগী, ২৭ জনই ঢাকার বাইরের: শনিবার রাত নয়টা। ডিএনসিসি হাসপাতালে এক এক করে আসতে থাকে এম্বুলেন্স। পাঁচ দশ মিনিটের বিরতিতে আসছেন রোগী। রাত ১২টা পর্যন্ত এম্বুলেন্সে ১৬ জন ও ব্যক্তিগত গাড়িতে করে ২ জন রোগী আসেন। এই ১৮ রোগীর মধ্যে ১৭ জনই আসেন রাজধানীর বাইরে থেকে। যাদের সবাই পেয়েছেন ভর্তির সুযোগ। কাউকেই ফিরে যেতে হয়নি খালি হাতে। একই এম্বুলেন্সে মা ও ছেলে আসেন ফরিদপুরের গোয়ালন্দ থেকে। তাদের ভর্তির জন্য অপেক্ষা। মা ও ছেলে দুজনেই অক্সিজেন স্বল্পতায় ভুগছিলেন। এম্বুলেন্সে তাদের ভাড়া নেয়া হয় ১৭ হাজার টাকা।
ময়মনসিংহ থেকে বাবা আজগর আলী চৌধুরীকে নিয়ে আসেন মোনেম চৌধুরী। বলেন, বাবা করোনা আক্রান্ত ৩ দিন ধরে। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। বাধ্য হয়ে নিয়ে আসেন এই হাসপাতালে। শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন তিনি। হাসপাতালে আসার পর পরই অক্সিজেন দেয়া হয় ওই রোগীকে।
এছাড়াও কথা হয় আলীপুর, পটুয়াখালী থেকে আসা মাইনুল তরফদারের শ্যালকের সঙ্গে। তিনি বলেন, পটুয়াখালীর বেসরকারি হাসপাতালে থাকা অবস্থায় অক্সিজেন সংকট দেখা দেয়। দিন দিন অবস্থা খারাপ হতে থাকে দুলাভাইয়ের। এরপর ঢাকা মেডিকেল ঘুরে এখানে নিয়ে আসি। আসার সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি করাতে পেরেছি। কোনো সমস্যা হয়নি।
মাইনুল তরফদারের মতো সবাই ভর্তি হতে পারলেও জানানো হয় আইসিইউ বেড খালি নেই। রাত ১২টার দিকে গোয়ালন্দ থেকে দুই রোগীকে নিয়ে আসা হয়। তাদেরও অক্সিজেন সমস্যা। হাসপাতালে ভর্তির পর তাদের অক্সিজেন দেয়ায় স্বস্তি পান ওই রোগীদের স্বজনরা।