এটা চলে আসছে। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে, বিশেষত গ্রামে। কোনো নারী হারিয়েছেন তার জীবনসঙ্গীকে। হৃদয়, মন এমনিতেই ভেঙে চূর্ণ, বিচূর্ণ। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। মুহূর্তের মধ্যে তাকে আলাদা করে ফেলা হয় অন্যদের থেকে। পরিয়ে দেয়া হয় সাদা পোশাক।
অনেক ক্ষেত্রেই দীর্ঘ জীবন তাকে পাড়ি দিতে হয় এ পোশাক পরেই। কিন্তু এই প্রথা বা নিয়মের উৎস কি? কীভাবে চালু হলো এ ব্যবস্থা। বিভিন্ন ধর্মই বা কী বলে এ ব্যাপারে। মানবজমিন এ ব্যাপারে কথা বলেছে ধর্মের খ্যাতিমান স্কলারদের সঙ্গে। মতামত নেয়া হয়েছে সমাজ বিজ্ঞানী ও নারী অধিকার কর্মীদেরও।
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম, খ্যাতিমান ইসলামি চিন্তাবিদ মুফতি মিজানুর রহমান বলেন, আসলে ইসলামে যেটা আছে স্বামীর মৃত্যুর পরে স্ত্রীর জন্য একটি সময় যেটাকে আমরা ইদ্দত বলি। শোক পালনের সময় এই সময়টাতে তার নিজ বাড়িঘরে অবস্থান করবে। প্রয়োজন ছাড়া সে বাইরে কোথাও যাবে না। এবং স্বামী জীবিত অবস্থায় যে ধরনের সাজ সজ্জা করার নিয়ম ছিল সেটা করবে না। এটা ইসলামে উল্লেখ আছে। কিন্তু এর বাইরে সাদা কাপড় পরার কথা কোথাও উল্লেখ নেই। এই জাতীয় কথা যেটা বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে প্রচলিত আছে। এগুলো হলো কুসংস্কার। এগুলো মানুষের বানানো। সাদা কাপড় পরার কোনো বিষয় নেই। প্রয়োজনে সে ভালো কাপড় পরতে পারবে। এ বিষয়ে ধর্মে কোনো বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু স্বামী থাকাবস্থায় মানুষ যেভাবে সাজ সজ্জাটা করে সেভাবে করা যাবে না। এ ছাড়া অন্য যা কিছু সেগুলো মানুষের মনগড়া বিষয়। যেটা বিধবা নারীকে একঘরে করে তার জীবনযাপন ব্যাহত করার এক ধরনের হাতিয়ার। যেটা কোনো ভাবেই উচিত নয়। বরং তাকে সঙ্গ দেয়া, তার মানসিক বিষণ্নতা দূর করতে সাহস জোগানো উচিত।
কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, ইসলাম ধর্মে বলা আছে স্বামীর মৃত্যুর পরে স্ত্রী চার মাস দশদিন ইদ্দত পালন করবেন। ইদ্দত বলতে শোক পালন করা। আমাদের ধর্মে বিশেষ করে কোরআন-হাদিসে কোথাও স্বামীর মৃত্যুর পরে সাদা রংয়ের কাপড় বা শাড়ি পরার কথা উল্লেখ নেই। অথচ আমাদের দেশে এটা চলছে। এটা তো কুসংস্কার। এটা মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের থেকে এসেছে। এমনিতে একজন ইচ্ছা করলে সাদা শাড়ি পরতে পারবেন। সেটা তার ইচ্ছা। এটা কোনো হুকুম নয়। কিন্তু এটা নিয়ে ধর্মীয় কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
বাংলাদেশ হিন্দু ফাউন্ডেশনের (বাহিফা) সহ-মহাসচিব এডভোকেট নিতাই প্রসাদ ঘোষ বলেন, আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থ বেদ-এর কোথাও সাদা শাড়ি পরতে হবে উল্লেখ নেই। এটা একটি প্রথা হয়ে গেছে। এটা নিঃসন্দেহে কুসংস্কার। তবে বর্তমানে আমাদের দেশে ২৫ ভাগ বিধবা নারী সাদা শাড়ি পরেন। বাকি ৭৫ ভাগ স্বাভাবিক নিয়মেই রঙিন শাড়ি পরেন। তিনি বলেন, সাদা শাড়ির প্রচলন হয় সতীদাহ প্রথা বন্ধ হওয়ার পর থেকে। এ সময় থেকে হিন্দু বিধবা নারীদের সাদা শাড়ি এবং নিরামিষ খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়।
এ বিষয়ে মানবাধিকার আইনজীবী এলিনা খান বলেন, বিধবার সঙ্গে সাদা শাড়ির কি সম্পর্ক আমি জানি না। প্রথমত, লোকে ধরে নেয় স্বামী মারা যাওয়ার পরে আমার রংচং সব চলে গেল। আমি সব হারিয়ে ফেললাম। জীবনের সাধ বলতে কিছু নেই। স্বামীও চলে গেছে আমিও রংহীন হলাম। যেটা সেই সনাতন সময় থেকে প্রচলন হয়ে আসছে। কিন্তু এটা ইসলামের কোথাও বলা আছে বলে আমার জানা নেই। আমাদের ক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স বা মৃত্যু হলে সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে আমার সকল সম্পর্ক ছেদ হয়ে গেল। সে ক্ষেত্রে সাদা শাড়ি পরার কথা কোথাও বলা হয়নি। বিশেষ করে হিন্দু মেয়েরা সাদা শাড়ির বিষয়টা বেশি অনুসরণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে বর্তমানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সেখানে বিধবা মেয়েরা সাদা শাড়ি পরে না। কিন্তু আমাদের দেশে গ্রাম-বাংলায় হিন্দু মেয়েদের মতো অন্য ধর্মের মেয়েরা সাদা শাড়ি পরে। গ্রামের কিছু সহজ সরল মানুষ রয়েছে তারা কিছু বুঝে না বুঝে অন্যকে দেখে মনে করেন এটাই বুঝি পরতে হয়। এটা অজ্ঞতার কারণে, না জানার কারণে করে থাকেন। এটা কোনো ধর্ম, সমাজ, পরিবার কেউ কিন্তু বাধ্য করে না। কিছু কিছু পরিবার এটাকে খুব কঠোরভাবে অনুসরণ করে থাকেন। সুতরাং ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, একজন পুরুষ মানুষের স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে সে যদি সকল ধরনের পোশাক পরে ঘুরতে পারে তাহলে নারী কেন পারবে না। এটি হচ্ছে তার ইচ্ছা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারপারসন অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে আমাদের দেশের বিধবা নারীরা সাদা শাড়ি পরে থাকেন। যেটা গ্রাম অঞ্চলে এখনো আছে। শহরে কম দেখা যায়। এখানে সবাই স্বাধীন। এটা পরছে তারাই যারা পুরনো মূল্যবোধ ধরে রেখেছে। তাছাড়া পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাদেরকে এক ধরনের চাপের মধ্যে রেখেছে। এখন যে নারী বিধবা হয়ে শ্বশুরবাড়ি আছেন তিনি তো শ্বশুরবাড়ি, পাড়া প্রতিবেশীর নিয়ম কানুনের বাইরে যেতে পারবেন না। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীরা সাদা শাড়ি বাধ্য হয়ে পরে থাকেন। এজন্য আমাদের সমাজব্যবস্থা বহুলাংশে দায়ী।