তবুও ছুটছে মানুষ

Slider বাংলার মুখোমুখি

দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় সারা দেশ লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। কঠোর লকডাউনের ঘোষণা আসতেই করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা ছাড়ার হিড়িক পড়েছে। দিন-রাত দলে দলে রাজধানী ছাড়ছেন মানুষ। সড়কে মহাসড়কে বাড়ছে যানবাহনের চাপ। কয়েকগুণ বেশি ভাড়া আর গাদাগাদি করে স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই ছুটছেন তারা। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকলেও বাড়ি ফেরার জনস্রোতের কাছে পাত্তা পাচ্ছে না কোনো কিছুই। গণপরিবহন না পেয়ে পিকআপ ভ্যান, মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস, ব্যক্তিগত কার, সিএনজি অটোরিকশা কিংবা ভ্যানে চড়ে কয়েক ধাপে পৌঁছে যাচ্ছে নিজ নিজ গন্তব্যে।

অনেকেই ছুটছেন পায়ে হেঁটে। বাড়ি ফেরা যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় রয়েছে ফেরি ঘাটেও। শিমুলিয়ায় প্রতিটি ফেরিতে গাদাগাদি করে পদ্মা পার হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। এদিকে আজ থেকে গণপরিবহন বন্ধ থাকবে গতকাল সরকারের এমন প্রজ্ঞাপনের পর সড়কে মানুষের চাপ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ফলে রাজধানী থেকে বের হওয়ার প্রতিটি এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। আব্দুল্লাপুর, গাবতলী, গুলিস্তান ও যাত্রাবাড়ী টার্মিনাল এলাকায় যানবাহনের সংকটে পড়েন অনেকে। ফলে এসব এলাকায় জনজট দেখা গেছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত একুশটি জেলার মানুষজন যাতায়াত করেছেন ফেরিতে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা মুন্সীগঞ্জে লকডাউনের কারণে নানা জায়গায় চেকপোস্ট থাকায় মানুষজন হেঁটে চেকপোস্ট এলাকা অতিক্রম করে স্থানীয় পরিবহন দিয়ে ফেরিঘাটে পৌঁছাচ্ছেন মানুষ। তবে বিপুলসংখ্যক মানুষ এক সঙ্গে গাদাগাদি করে ঢাকা ছাড়ায় সারা দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়াবে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। তারা বলছেন, রাজধানী ঢাকায়ও এখন করোনা সংক্রমণ উচ্চমাত্রায় বিদ্যমান। ফলে গাদাগাদি করে যাতায়াতে এসব মানুষ নিজেরা সংক্রমিত হয়ে বাড়ি গিয়ে পরিবারের বাকি সদস্যদেরও করোনায় সংক্রমিত করবে। এতে সরকার যে কারণে লকডাউন দিচ্ছে উল্টো বিপরীত ফলাফল আসবে।

অনেকেই বলেছেন, এবারের লকডাউন কঠোরভাবে পালিত হবে। লকডাউন ও বিধিনিষেধ কতদিন চলবে তাও জানেন না তারা। সামনে ঈদ। ঈদুল ফিতরের মতো লকডাউন টানা ঈদুল আজহা পর্যন্ত চলতে পারে। আর ঈদের আগে লকডাউন দেয়ায় কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকা ছেড়েছেন।

বিধিনিষেধ না মেনেই রাজধানী ছেড়ে যাওয়া অনেকেই বলেছেন, সরকার আগে থেকেই লকডাউনের ঘোষণা দিয়েছেন। এতে মানুষ ঢাকা ছাড়তে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এরইমধ্যে লকডাউন আরও ৩ দিন পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে আরও বেশি মানুষ গ্রামে যাচ্ছেন। সরকারই জনগণকে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন ঢাকা ছেড়ে যাওয়া লোকজন। তারা বলছেন, হঠাৎ করে লকডাউন দিয়ে ও সড়কে কড়াকড়ি পাহারা বসালে কেউ ঢাকা ছেড়ে যেতে পারতো না।
গতকাল সকালে রাজধানীর গাবতলী এলাকায় দেখা যায়, সড়কের দু’পাশ ধরে পায়ে হেঁটে আমিন বাজার ব্রিজ পার হচ্ছেন ঘরমুখো মানুষ। মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজি, মালবাহী ট্রাক ভর্তি করে ঢাকা ছাড়ছেন তারা। সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন জেলা শহরেরর এসব বাহনে যাত্রী তুলে দিচ্ছেন এক শ্রেণির দালালরা। ভাড়া নিয়ে চলছে দর কষাকষি। কয়েকগুণ ভাড়া বেশি, আর গাদাগাদি করে একেকটি মাইক্রোবাসে যাত্রী তোলা হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ জন। এতে বয়স্ক, নারী ও শিশুরা নানা অসুবিধায় পড়েছেন।

নওগাঁগামী যাত্রী মো. মিরাজ জানান, গাবতলী এলাকায় সকাল থেকে মাইক্রোবাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। মাইক্রোবাসে ভাড়া বেশি চাওয়ায় ২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বিভিন্ন বাহনের জন্য ভাড়া কষাকষি করেছেন। পরে আমিন বাজার পার হয়ে এক দালালের মাধ্যমে ১৫০০ টাকায় মাইক্রোবাসের এক সিট পেয়েছেন। তিনি বলেন, গত বছর লকডাউনে ঢাকায় চাকরি হারিয়েছেন। এরপরে আত্মীয়স্বজন থেকে ঋণ নিয়ে তখন জীবনযাপন করেছেন। এখন লকডাউন শুনলেই ভয় হয়। সবকিছু বন্ধ থাকলে হঠাৎ চাকরি চলে যেতে পারে। এজন্য আগেই বাড়ি যাচ্ছি। গ্রামে গেলে চাকরি যাওয়ার ভয় নেই, কিছু একটা করে খেতে পারবো।

দিনাজপুরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শফিউল্ল্যাহ। কাঁধে ৪ বছরের নাতি হিমেল, দুই হাতে বড় বড় দুটি ব্যাগ নিয়ে আমিন বাজার ব্রিজ পার হচ্ছেন। কথা হলে তিনি জানান, তিনি দিনাজপুরের পার্বতীপুর এলাকায় ব্যবসা করেন। গত শুক্রবার ঢাকা থেকে মেয়ে ও মেয়ের জামাই কল দিয়ে ঢাকায় আসতে বলে। জামাই একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ছুটি পাননি। তাই মেয়ে ও নাতিকে নিয়ে লকডাউনের আগেই গ্রামে যাচ্ছেন তিনি। লকডাউন চললে ঢাকায় নানা অসুবিধায় পড়তে পারেন। এ ছাড়া কোরবানি ঈদের আগে লকডাউন না ছাড়লে নাতিকে ঈদের সময় দেখতে পারেন না। এজন্য আগেই বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। কীভাবে যাবেন জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, এখান থেকে যমুনা ব্রিজ পর্যন্ত মাইক্রোবাসে যাবো। সেখান থেকে ভেঙে ভেঙে কয়েক ধাপে বাড়িতে পৌঁছাবো।

মালিবাগ মোড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মাইক্রোবাসের জন্য অপেক্ষা করছেন ভোলা জেলার দৌলতখানের আমির হোসেন। তিনি বলেন, রাজধানীতে সবাই সুখে থাকতে পারে না। এই শহর আমাদের জন্য নয়। করোনার মধ্যে চাকরি হারিয়েছি। বউ গার্মেন্টে চাকরি করতো তা দিয়েই এতদিন চলছি। কোনো সঞ্চয় করতে পারিনি। তাই এলাকায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলাম। গত মাসে বাড়িওয়ালাকে বলে বাসা ছেড়ে দিয়েছি। ১লা জুলাই সপরিবারে ভোলায় যাওয়ার কথা ছিল। এখন শুনেছি লকডাউন শুরু হবে। লকডাউন শুরু হলে তো তখন যেতে পারবো না। এজন্য আজ চলে যাচ্ছি। ১২ হাজার টাকায় প্রাইভেটকারে করে লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরীর ঘাট হয়ে ফেরিতে উঠে চলে যাব।

এদিকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলগামী ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়েছে। বাস কাউন্টারগুলোতে বিক্রি হচ্ছে মাইক্রোবাস ও ব্যক্তিগত গাড়ির টিকিট। ভাড়া বেশি হলেই মিলে সিট। অন্যথায় মালবাহী ট্রাক কিংবা লরিতে করে পৌঁছে দেয়া হয় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। প্রতিটি বাহনে রয়েছে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব। অনেকের মুখেই নেই মাস্ক। যাত্রীদের ভোগান্তিও ছিল চরমে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *