করোনা পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। দেশে শনাক্ত ও মৃত্যু দুটোই হু হু করে বাড়ছে। একদিনে শনাক্তের হার ২০ দশমিক ২৭ শতাংশে পৌঁছেছে। দেশের কিছু জেলায় শনাক্তের হার ৬০ থেকে ৯০ শতাংশও উঠেছে। জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সতর্ক করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, বিধিনিষেধ না মানলে দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আগামী দিনগুলোতে শোচনীয় হতে পারে। সীমান্তবর্তী এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এর বিস্তার ছড়িয়ে পড়ছে। তাই দেশে চলমান লকডাউন ও বিধিনিষেধ মানাতে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর হতে অনুরোধ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকালের তথ্য মতে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৭২৭ জন।
এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৮৫ জনের। একদিনে শনাক্ত রোগীর এই সংখ্যা গত ৭১ দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর আগে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে গত ১৩ই এপ্রিল একদিনে ৬ হাজার ২৮ জন রোগী শনাক্তের খবর এসেছিল। এখন পর্যন্ত সরকারি হিসাবে করোনাতে মোট শনাক্ত হলেন ৮ লাখ ৬৬ হাজার ৮৭৭ জন। এখন পর্যন্ত দেশে সরকারি হিসাবে করোনায় মারা গেছেন ১৩ হাজার ৭৮৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৩ হাজার ১৬৮ জন। দেশে করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ৯১ হাজার ৫৫৩ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ। এখন পর্যন্ত দেশে রোগী শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ৩১ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যু হার এক দশমিক ৫৯ শতাংশ।
এদিকে, খুলনা বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ৩৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। ২ হাজার ২৭৩টি নমুনা পরীক্ষায় ৯০৩ জন শনাক্ত হয়েছেন। এ বিভাগের চুয়াডাঙ্গা জেলায় শনাক্তের হার ৯০ শতাংশের উপরে। একই সময়ে রাজশাহী বিভাগে শনাক্তের হার ১৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। ঢাকা বিভাগে শনাক্তের হার বাড়ছে। এ বিভাগে শনাক্তের হার ১৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ঢাকা জেলায় (মহানগরসহ) শনাক্তের হার ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
করোনা পরিস্থিতি শোচনীয় হওয়ার আশঙ্কা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের: মানুষকে সতর্ক করা হয়েছে যে, দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি আগামী দিনগুলোতে শোচনীয় হতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। গতকাল কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ভার্চ্যুয়াল স্বাস্থ্য বুলেটিনে এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। তিনি বলেন, কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নাগরিকরা সরকারের নেয়া কার্যক্রমের সহযোগিতা না করলে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে বাংলাদেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি শোচনীয় অবস্থায় চলে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে প্রথম থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্তের হার ১৩ শতাংশের মতো হলেও গত ৭ দিনের পরিসংখ্যান যাচাই করলে দেখা যাবে মৃত্যুর হার এবং সংক্রমণ শনাক্তের হার বেড়েই যাচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে মৃত্যুর হার এবং সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই মুখপাত্র। এমন অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং হাসপাতালে সেবাদান প্রক্রিয়া স্থিতিশীল রাখার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন এলাকায় প্রশাসনের নেয়া পদক্ষেপ মেনে না চললে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, দেশে চলমান লকডাউন ও বিধিনিষেধ মানাতে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর হতে অনুরোধ করেছেন। করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এ অনুরোধ করেন তিনি। বলেন, দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এর বিস্তার ছড়িয়ে পড়ছে। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, সেই সঙ্গে আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে মৃত্যু। বিদ্যমান পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ঢাকার চারপাশে কঠোর লকডাউন দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র বলেন, সংক্রমণ কমিয়ে আনার জন্য চলমান লকডাউন ও বিধিনিষেধকে কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য সকলকে অনুরোধ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রয়োজনে কঠোর হতে অনুরোধ করা হলো। বর্তমানে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে চলমান লকডাউন এবং বিধিনিষেধে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কিছুটা অসুবিধা সৃষ্টি হচ্ছে জানিয়ে অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি মোকাবিলা, হাসপাতালের প্রস্তুতি নিতে সুযোগ দেয়া
এবং মৃত্যু কমিয়ে আনার জন্য সকলকে এ সহযোগিতা করতে হবে।
অরক্ষিত ঢাকায় স্বাস্থ্যবিধি উধাও: দেশে আবারো বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। বিশেষ করে দেশের সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটির নতুন ধরন। এতে অন্যান্য অঞ্চলসহ রাজধানীর আশেপাশের জেলাগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে গত সোমবার ঢাকার আশপাশের ৭টি জেলায় লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। একইসঙ্গে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে দূরপাল্লার বাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া মঙ্গলবার বন্ধের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়েছে ট্রেন চলাচলও। তবে ইতিমধ্যেই রাজধানীতে কয়েকদিনের ব্যবধানে শনাক্তের হার বাড়লেও ঢাকাকেন্দ্রিক কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। যদিও সরকারের পূর্ব ঘোষিত বিধিনিষেধ চলমান রয়েছে। তবে সেটি এখন দৃশ্যত অকার্যকর। রাজধানীর বাজার, শপিংমল কিংবা গণপরিবহন- সবখানেই স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে সবকিছুই চলছে স্বাভাবিকভাবে।
সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে গত ৫ই এপ্রিল গণপরিবহন চলাচলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ৭ দিনের বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল সরকার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ১৪ থেকে ২১শে এপ্রিল পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ দিয়ে সর্বাত্মক লকডাউন দেয়া হয়। এরপর তা একে একে আরও ৭ দফা বাড়ানো হয়। সর্বশেষ গত ১৬ই জুন চলমান বিধিনিষিধ আরও এক মাস বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন দেয়া হয়। যদিও চলমান এ বিধিনিষেধের কোনো সুফল মিলেনি। বরং ধীরে ধীরে তা একেবারে ভেঙে পড়েছে। এ অবস্থায় করোনার নতুন ধরন থেকে রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে সরকারের নতুন নির্দেশনা কতোটা কাজে দেবে? তা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। তবে নির্দেশনা যাই দেয়া হোক না কেন, তা বাস্তবায়নে সরকারকে যেমন কঠোর হতে হবে, তেমনি স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে জনগণকেও সচেতন হতে হবে বলে মনে করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। তিনি মানবজমিনকে বলেন, প্রথমত, রাজধানী হলো ঘনবসতিপূর্ণ। সেজন্য এখানে সামাজিক সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। এ অবস্থায় রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে সব মানুষকে ঘরে রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, রাজধানী এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে মানুষ চলাচল বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ মানুষ যেন রাজধানী থেকে গ্রামে যেতে না পারে এবং গ্রাম থেকে যেন ঢাকায় মানুষ আসতে না পারে। এটি হলো সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের নিয়ম। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের এমন সিদ্ধান্ত ভালো, তবে এখানে দু’টি দিক আছে। একটি হলো জনগণকে আগে থেকে সতর্ক করা হয়নি। মানুষের একটা প্রস্তুতি থাকার দরকার, যে কখন থেকে তারা সতর্ক হবে। অর্থাৎ সংক্রমণের কোন্ পর্যায় গেলে সরকার লকডাউন দিতে পারে এটি মানুষকে জানা থাকতে হবে। তখন মানুষ খেয়াল করবে যে সংক্রমণ কোন্ পর্যায়ে যাচ্ছে। সেই হিসেবে মানুষ প্রস্তুতি নেবে। সুতরাং সরকার সেই ভাবে সিদ্ধান্ত না নেয়ায় মানুষ অপ্রস্তুত অবস্থায় লকডাউনে চলে গেছে। একারণে যেমন মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে তেমনি এতে মানুষের সম্পৃক্ততাও কম। লোকজন একারণেই কোনো বিধিনিষেধ মানছে না। এ কারণে এতে সফলতা পুরোপুরি আসবে না। হয়তো আংশিক সুফল দেখা যেতে পারে।
এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সরকারের পূর্ব ঘোষিত বিধিনিষেধ যেমন সুফল আসেনি, তেমনি এই লকডাউনেও সুফল আসবে না, যদি সেটা বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা না থাকে। বিধিনিষেধ জনগণ মানতে উদ্বুদ্ধ হবে যখন তারা জানবে যে সরকার এ ক্ষেত্রে আন্তরিক। আমাকে বুঝতে হবে যে সরকার আন্তরিক হয়ে লকডাউন দিয়েছে কারণ সরকার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এবং তা জনগণকে সম্পৃক্ত করে। তাহলে এ থেকে সফলতা আসবে। কিন্তু লকডাউন বাস্তবায়নের জন্য যে কার্যক্রম হাতে নেয়া দরকার সেটা সরকার করছে না।