রাজধানীর কদমতলী থানাধীন মুরাদপুর এলাকায় ঘুমের ওষুধ সেবনের মাধ্যমে অচেতন করে মা-বাবা-বোনকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে শ্বাসরোধে হত্যাকারী মেহজাবিন ইসলাম মুনের (২৪) চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল রবিবার ঢাকা মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাস শুনানি শেষে এ রিমান্ডের আদেশ দেন। পাশাপাশি এ ট্রিপল মার্ডার মামলার আসামি মুন এবং তার স্বামী মো. শফিকুল ইসলাম অরণ্যের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৩১ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন আদালত।
২৪ বছর বয়সী মুন গত শুক্রবার গভীর রাতে মা, বাবা ও ছোট বোনকে হত্যা করার পর জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে বলেন- ‘তিনজনকে খুন করেছি, তাড়াতাড়ি আসেন, তা না হলে আরও দুজনকে (স্বামী-সন্তান) খুন করব।’ চাঞ্চল্যকর এ কা-ের পর নিহত মাসুদ রানার বড় ভাই সাখাওয়াত হোসেন কদমতলী থানায় মুন ও অরণ্যকে আসামি করে মামলা করেন। ওই মামলায় মেহজাবিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার স্বামী শফিকুল আহত অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাকে পুলিশি পাহারায় রাখা হয়েছে। সুস্থ হলে তাকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হবে বলে জানিয়েছেন কদমতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামাল উদ্দিন মীর। তিনি আরও জানান, পূর্বপরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকা- ঘটায় মেহজাবিন।
গ্রেপ্তার মুনকে গতকাল বিকাল ৩টার পর এজলাসে তোলা হয়। এর পর হত্যাকাণ্ডের জেরে করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কদমতলী থানার পরিদর্শক জাকির হোসেন। আদালত চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ডের আবেদনে বলা হয়, মুনের বাবা মাসুদ রানা দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে সৌদি আরব থাকতেন। মাঝেমধ্যে তিনি দেশে আসতেন। মাসুদ রানা তার মেয়ে মেহজাবিন ইসলাম মুনকে শফিকুল ইসলাম অরণ্যর সঙ্গে বিয়ে দেন। এর পর থেকে মুন সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্য তার মা মৌসুমী ইসলামকে বিভিন্নভাবে জ্বালা-যন্ত্রণা করত এবং টাকা-পয়সা দাবি করত। সম্পত্তি আসামিদের নামে লিখে দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করত। সম্পত্তি লিখে না দেওয়ার কারণে মুন এবং তার স্বামী অরণ্য ছয় মাস আগে থেকে মাসুদ রানা, তার স্ত্রী মৌসুমী এবং মেয়ে জান্নাতুল ইসলাম মোহনীকে মারার জন্য বিভিন্নভাবে পরিকল্পনা করতে থাকে। মাসুদ রানা তিন মাস আগে সৌদি আরব থেকে দেশে আসেন।
পূর্বপরিকল্পিতভাবে আসামিরা গত ১৮ জুন বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে মাসুদ রানার বাসায় আসে। মাসুদ রানা দম্পতি সব কিছু ভুলে আসামিদের বাসায় থাকতে দেন। সেদিন রাত ৯টা থেকে বিভিন্ন সময়ে চা-কফি ও পানির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে মাসুদ রানা, মৌসুমী ইসলাম ও মোহনীকে তা খাওয়ানো হয়। এতে সবাই অচেতন হয়ে গেলে আসামিরা গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে একে একে সবার মৃত্যু নিশ্চিত করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মুন মামলাসংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে। তবে কী কারণে, কেন? কী উদ্দেশ্যে মুন তার বাবা-মা ও বোনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে এবং হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আর কেউ জড়িত ছিল কিনা তা জানার জন্য সাত দিনের রিমান্ড প্রয়োজন।
রাষ্ট্রপক্ষে মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল রিমান্ড মঞ্জুরের পক্ষে শুনানি করেন। তবে আসামির পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
‘অনুশোচনা নেই, আরও ভালো আছি’
এজলাসে মুনকে স্বাভাবিকই দেখাচ্ছিল। কথাও বলেছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। কেন খুন করলেন এমন প্রশ্নে মুন বলেন, ‘পরকীয়া এবং পারিবারিক ঝামেলার কারণে খুন করেছি।’ আর কেউ সঙ্গে ছিল কিনা? এর উত্তরে বলেন, ‘না। আমি একাই হত্যাকা- ঘটিয়েছি।’ অনুশোচনা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে এ তরুণী বলেন, ‘না। আমার কোনো অনুশোচনা হচ্ছে না। বরং গতকাল থেকে আরও ভালো আছি। সুস্থ, স্বাভাবিক আছি।’
লোভ নাকি ক্ষোভ?
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, হত্যাকা-ের দুদিন আগে স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে মায়ের বাড়িতে বেড়াতে আসেন মেহজাবিন। এসেই তার ছোট বোন জান্নাতুলের সঙ্গে তার স্বামীর পরকীয়া রয়েছে বলে মা-বাবাকে অভিযোগ করেন। এ নিয়ে কথাকাটাকাটি হয়। তার জেরে ক্ষোভ থেকে তিনি এ হত্যাকা- ঘটিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি এমন সন্দেহও করা হচ্ছে যে, টাকা-পয়সা ও সম্পত্তির প্রতি লোভের কারণেই হত্যা করা হয়েছে।
পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মুন হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। নিহত মাসুদের বড় ভাই মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মাসুদ ২৬ বছর ধরে সৌদি আরব থাকে। বিয়ের পর থেকে মেহজাবিন ও তার স্বামী শফিকুল টাকা ও সম্পতির জন্য মাসুদের স্ত্রী মৌসুমীকে বিভিন্নভাবে জ্বালা-যন্ত্রণা দিত। মৌসুমী রাজি না হওয়ায় ছয় মাস আগে তাদের হত্যার জন্য পরিকল্পনা করে মেহজাবিন দম্পতি। তিন মাস আগে মাসুদ দেশে ফেরে। এর পর পরিকল্পনা অনুযায়ী চায়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে অচেতন করে। এর পর বাবা-মা ও বোনকে ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে।
ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের ডিসি শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, ছোটবেলা থেকেই মেহজাবিন ও তার বোনকে দিয়ে মা মৌসুমী দেহব্যবসায় বাধ্য করে। এ ছাড়া বাবা মাসুদ আরেকটি বিয়ে করে সংসার গড়েন। এসব ক্ষোভ থেকেই মেহজাবিন তাদের খুন করে বলে স্বীকার করেছে। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, টাকা-পয়সা ও সম্পতির প্রতি লোভ থেকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা সব বিষয় সামনে রেখে তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছি। ইতোমধ্যে মেহজাবিনের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আমরা রিমান্ডে হত্যকা-ের আদ্যপান্ত জানার চেষ্টা করব।
জানা গেছে, এর আগে মেহজাবিন তার গৃহশিক্ষককে হত্যা করে ১ মাস ২২ দিন জেল খাটেন। ওই হত্যা মামলাটি ২০১৬ সালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় ছিল। ওই মামলায় মেহজামিন, তার মা মৌসুমী এবং তার আরেক খালা আসামি। ওই মামলায় সর্বশেষ তারা জামিনে ছিলেন।
ময়নাতদন্ত সম্পন্ন
গত শনিবার সকালে রাজধানীর কদমতলী থানার মুরাদপুর হাজি লালমিয়া সরকার রোডের ২৭৪/১ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলার বাসায় বাবা-মা ও বোনকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধে হত্যা করেন মেহজাবিন। পরে তিনিই ট্রিপল নাইনে ফোন করে তিন খুনের বিষয়টি জানান; পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। সন্তানের হাতে প্রাণ হারানো বাবা মাসুদ রানা, মা মৌসুমী ইসলাম ওরফে জোসনা ও ছোট বোন জান্নাতুল ইসলাম মোহনীর ময়নাতদন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) মর্গে সম্পন্ন হয়েছে।