করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের পর যে কয়টি দেশ গণটিকাদান শুরু করতে পেরেছিল, বাংলাদেশ তার অন্যতম। বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ টিকা কিনতে চুক্তি হয়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি অক্সফোর্ডের টিকা দিয়ে দেশে শুরু হয় গণটিকাদান। দুই চালানে ৭০ লাখ ডোজ দিয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে মার্চে রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ভারত।
এর পর টিকাদান অব্যাহত রাখতে চতুর্মুখী তৎপরতা শুরু করে ঢাকা। টাকা দিয়ে টিকা কেনার পাশাপাশি দেশে উৎপাদন করতেও চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তির প্রক্রিয়া চলছে। টিকার অতিরিক্ত মজুদ রয়েছে এমন দেশগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ করা হচ্ছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কেনা টিকার বিষয়ে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। কবে চুক্তি সম্পন্ন হবে, টিকা আসবে- তা নিশ্চিত নয়।
অন্যদিকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ধাপে ধাপে ৪৪ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে পেয়েছে বাংলাদেশ। শিগগিরই ১০ লাখের বেশি ডোজ আসছে কোভ্যাক্স থেকেও। ভারত দুই চালানে ৭০ লাখ ডোজ সরবরাহের পাশাপাশি দুই দফায় বাংলাদেশকে ৩৩ লাখ ডোজ উপহার হিসেবেও দেয়। গত মাসে চীন উপহার দেয় সিনোফার্মের তৈরি টিকার পাঁচ লাখ ডোজ। আগামীকাল রবিবার আসছে সিনোফার্মের আরও ছয় লাখ
ডোজ। এ ছাড়া গতকাল শুক্রবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, স্বল্প আয়ের দেশগুলোর টিকা নিশ্চিতে গড়ে ওঠা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগ কোভ্যাক্স থেকে শিগগিরই পাওয়া যাবে ১০ লাখ ৮০০ ডোজ টিকা। তবে কবে নাগাদ তা ঢাকায় আসবে, সেটি জানা না গেলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন শিগগিরই এই টিকা দেশে আসবে।
টিকা সংকটে থমকে যাওয়া টিকাদান কার্যক্রম চালু রাখতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগেও যখন সুফল মিলছে না, তখন কদিন আগে আপেক্ষ প্রকাশ করতে দেখা যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনকে। বিভিন্ন দেশ থেকে সময়মতো টিকা না আসায় তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশকে টিকা পাঠাতে অনুরোধ জানিয়েছে। সবাই বলে টিকা দেবে। কিন্তু হাতে আসছে না।
শুরুতে টিকার জন্য একমুখী যোগাযোগ চালালেও করোনা নিয়ন্ত্রণে না আসায় শতভাগ ভ্যাকসিন সক্ষমতা নিশ্চিতে এখন চতুর্মুখী তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। আর এই তৎপরতার আওতায় কেবল টিকা কেনা বা সংগ্রহ করা নয়, দেশেও তা উৎপাদনে মনোযোগী সরকার। টিকা পাওয়া যেতে পারে সম্ভাব্য এমন সব জায়গাতেই এখন যোগাযোগ করছে সরকার। তবে বিভিন্ন উৎস থেকে দ্রুত টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
অন্যদিকে চীনের দ্বিতীয় দফা উপহারের ছয় লাখ করোনার টিকা আগামীকাল রবিবার ঢাকায় আসছে। ঢাকায় চীনা দূতাবাসের উপরাষ্ট্রদূত হুয়ালং ইয়ান গতকাল শুক্রবার সকালে তার ফেসবুক পেজে এ তথ্য জানান। এগুলো চীনের সিনোফার্মের তৈরি। চীন এর আগে ১২ মে সিনোফার্মের পাঁচ লাখ টিকা উপহার দেয় বাংলাদেশকে। ২১ মে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের সঙ্গে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর ফোনালাপ হয়। এ সময় দ্বিতীয় দফায় উপহার দেওয়ার কথা জানান ওয়াং ই।
চীনা উপহারের টিকা এলেও দেশটি থেকে কেনা টিকা কবে আসবে সেটি নিশ্চিত নয়। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, চীনের সিনোফার্ম থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছিল ঢাকা। নন-ডিসক্লোজার চুক্তি সইও হয়। কিন্তু গত মাসের শেষ সপ্তাহে সরকারের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের কাছে ওই টিকার দাম প্রকাশ করলে ক্ষুব্ধ হয় চীন। ফলে চলতি মাসে ওই টিকার প্রথম চালান আসা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সিনোফার্মের টিকা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি দামে কিনেছে শ্রীলংকা। বাংলাদেশ বিষয়টি অনিচ্ছাকৃত উল্লেখ করে দুঃখ প্রকাশও করেছে। অন্য একটি চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাকের সঙ্গেও যোগাযোগ করছে বাংলাদেশ। চলতি সপ্তাহেই তাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হবে বলে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানান। এ ছাড়া সিনোফার্মের সঙ্গে যৌথভাবে টিকা উৎপাদনের আলোচনাও অনেক দূর এগিয়েছে। চলতি সপ্তাহেই এ সংক্রান্ত ঘোষণা আসতে পারে বলে জানা গেছে।
রাশিয়া থেকেও এক কোটি টিকা কেনার প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে সরকার। এ সপ্তাহেই আলোচনা শেষ করে জুলাইয়ে স্পুটনিক-ভি টিকার প্রথম চালান পেতে আগ্রহী ঢাকা। সব কিছু ঠিকমতো এগোলে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসব টিকা দেশে আসবে। এ লক্ষ্যে স্পুটনিক-ভির উৎপাদক ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি অব রাশিয়ান ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (সিআরডিআইএফ) সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত করা হয়েছে। গত ৯ মে ঢাকা-মস্কো চুক্তির খসড়ায় আইন মন্ত্রণালয় ২৯ সুপারিশ দেয়। সিআরডিআইএফ এসব দফার বিপরীতে তাদের মতামত দেয়। ১২ মে সেই মতামত বাংলাদেশে পৌঁছায়। ২৮ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত মতামত জানায়। চীনের মতো রাশিয়ার টিকাও বাংলাদেশে উৎপাদন হবে বলে জানা গেছে। এ জন্য আলাদা চুক্তিও হবে।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা ভাইরাসের টিকা দিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি দেশে গণটিকাদান কর্মসূচি চালু হয়। সেরামের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, ছয় মাসে তিন কোটি ডোজ টিকা আসার কথা ছিল। কিন্তু দুই চালানে ৭০ লাখ টিকা সরবরাহের পর রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ভারত। এর বাইরে ভারত সরকার উপহার হিসেবে ৩৩ লাখ ডোজ টিকা দেয়। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ায় নিজেদের চাহিদা মেটাতে গত মার্চে টিকা রপ্তানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করে ভারত। এতে বাংলাদেশ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে। যারা এই টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের দ্বিতীয় ডোজ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।